মো. মাইদুল ইসলাম: পড়ন্ত বেলা দুপাশে বিলের মাঝে সরু পিচঢালাই রাস্তা। গ্রামবাংলার চিরচেনা নয়নাভিরাম দৃশ্য। বাইক্কা বিল যাওয়ার সময় মনে আপনা আপনি গেয়ে উঠে 'গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায় রে'। এছারাও চা বাগান, টিলা, লেক, রাবার বাগান, লেবু বাগান সব মিলিয়ে সবুজের ছড়াছড়ি চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলে।
চোখ যতদূর যায় দেখা মেলে সুধু সবুজ চাবাগান
প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষেই বন্ধুরা বলতেছিলো একটা ট্যুর দিবো। কিন্তু দুইয়ে দুইয়ে চার আর মিলেনি তাই যাওয়াও হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ কলেজর কয়েকজন বন্ধুর সাথে পরিকল্পনা হলো শ্রীমঙ্গল ঘুরতে যাবো একদিনের জন্য। ভাবলাম ভার্সিটির বন্ধুরাও যেহেতু ট্যুরের কথা বলেছিলো ওদেরও বলি। ওদের বলায় ওরাও রাজি হলো। ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন তো রাজি হলোই। সাথে বন্ধু রানা বলল ওর সংগঠন মুক্ততরীর (নারায়ণগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন) কয়েকজন ওর সাথে যাবে। এদিকে শাকিল মাহামুদ জানালো ওর সাথে ওর কলেজের ৪ বন্ধুও যাবে। সব মিলিয়ে বিশাল ২১ জনের টিম হয়ে গেলাম আমরা। নির্ধারিত হলো শনিবার (২৩ জানুয়ারি) আমরা সারাদিন শ্রীমঙ্গল ঘুরবো।
আমাদের পরিকল্পনা ছিলো শুক্রবার রাতে উপবন এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গল যাবো তবে বিপত্তি হলো রাত ১:৩০ এ ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে যাবে। এত রাতে পৌঁছালে ঝামেলা তাই সিদ্ধান্ত হলো সিলেটগামী সুরমা মেইলে আমরা যাবো। ২১ জানুয়ারি রাত ৯ টায় সুরমা মেইলে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। তবে আমার যেই ৩ জন কলেজ বন্ধু নিয়ে প্রথমে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম শেষ পর্যন্ত তারাই পারিবারিক সমস্যার কারণে যাবেনা বলল! ডিপার্টমেন্টের বন্ধু রিয়াজ, ফয়সাল, তাসিব, শাকিল মাহমুদ, রানা, অহিদুল, মোহাম্মদ শাকিল, ফারহানসহ সব মিলিয়ে ১৭ জনের টিম নিয়ে আমরা রওনা হলাম। ট্রেন কমলাপুর স্টেশন থেকে বের হতেই শুরু হলো আড্ডা-গান, শেষ রাতে একটু সবাই ক্লান্তি দূর করতে আড্ডায় ক্ষ্যান্ত দিলেও শায়েস্তাগঞ্জ পার হতেই কুয়াশাচ্ছন্ন শ্রীমঙ্গলে অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই।
রাস্তার দুপাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতে সকাল ৬ঃ৩০ এর দিকে আমরা পৌঁছালাম শ্রীমঙ্গল। আগে থেকেই আমি দুটো গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলাম, তারা স্টেশনেই ছিলো। চাদের গাড়িতে উঠেতো সবার সে কি উল্লাস! প্রথমেই আমরা চলে গেলাম পানসী রেস্টুরেন্টে। সেখানে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সেরে আমরা রওনা হলাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে।
লাউয়াছড়া যাওয়ার পথ আমাদেরকে রীতিমত অবাক করে দিয়েছিলো! সকাল সকাল তেমন কোন গাড়ি বা মানুষ ছিলো না, দুপাশে গাছ উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছিলো। হীম শীত উপেক্ষা করে আমরাও গাড়ির উপরে উঠে বসে শুরু করলাম গান, সাথে ছবি তোলা, ভিডিও করা। এত চমৎকার রাস্তায় ছুটে বেড়ানো হয়তো এর আগে আমাদের কারোই হয়নি। ৮ঃ৩০ এর দিকে আমরা নামলাম উদ্যানের সামনে। নেমেই সেখানে সবাই সকালের চা পান সেরে নিলাম। উদ্যানে প্রবেশ শুরুর সময় ৯ টা তাই আমরা সেখানে বাহিরেই কিছু ফটোসেশান করলাম। এরপর টিকিট মাস্টার আসলে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমরা যেহেতু সবাই শিক্ষার্থী তাই আইডি কার্ড দিয়ে ২০ টাকা করে আমাদের প্রবেশ মূল্য দিতে হয়েছে।
যাদের নিরিবিলি জায়গা ভালো লাগে, উদ্ভিদ নিয়ে জানার আগ্রহ তাদের সময় নিয়ে লাউয়াছড়া ঘুরতে ভালোলাগবে। তবে আমাদের টিম বড় হওয়ায় এবং একদিনে অনেকগুলো জায়গা ঘুরবো তাই আমরা এখানে বেশি ভেতরে যাইনি। গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে বড় বড় পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন গাছ, বিরিল প্রজাতির গাছের দেখা মিলবে এখানে। একটু সামনে গেলেই দেখা মিলবে রেল লাইন। রেললাইনে যেয়ে আমরা সবাই ছবি তুললাম, রেললাইনের এখানেই হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র 'আমার আছে জল'-এর শুটিং হয়েছিলো। রেললাইনের বাম পাশ দিয় সামনে গেলেই দেখা মিলবে গবেষণা কেন্দ্র। আমরা ১ ঘন্টা সময়ের মত এখানে থেকে বের হয়ে যাই মাধবপুর লেকের উদ্দেশ্যে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে যা যা আছে
জীববৈচিত্রের অভয়াশ্রম হিসাবে লাউয়াছড়া ব্যাপক সমাদৃত। সরকারী হিসাব অনুযায়ী, ১২০০ হেক্টরের বনাঞ্চলজুড়ে প্রায় আড়াই হাজারের অধিক বন্যপ্রানী রয়েছে যার মধ্যে দূর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় ৪৬০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এখানে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক, বিলুপ্তপ্রায় হনুমান, শকুন, লজ্জাবতী বাণর, মায়া হরিণসহ নানা প্রাণীর দেখা মিলে এই উদ্যানে। এছাড়াও প্রায় ৬৮ হাজার উদ্ভিদ রয়েছে এখানে।
চারপাশে চা'য়ে ঘেরা উঁচু উঁচু টিলা আর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে লেক। মাধবপুর লেকে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো লাল পদ্ম! লেকের পাড়ে বসে লাল পদ্ম দেখতে দেখতে-দেখতে কিছু সময় বিশ্রাম নেয়া যেতেই পারে এখানে। লেকের পাড় দিয়ে সামনে গেলেই শুরু টিলা, একের পর এক টিলা সবগুলোর বুকে সবুজ চা বাগান ভ্রমনপিপাসুদের মনে নাড়া দিবেই। টিলার উপর থেকে লেকের সৌন্দর্য যেন আরও বেশি মনে হয়। লেক, টিলা আর চা বাগানের মিশেল পেয়ে ক্যামেরায় বন্ধী করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো সবাই। সেই সাথে পুরো টিম মেম্বাররাও এক ফ্রেমে বন্ধী হলাম এখানে।