শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

হিমোফিলিয়া : রক্তের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ জনিত রোগ

শনিবার, এপ্রিল ১৬, ২০২২
হিমোফিলিয়া : রক্তের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ জনিত রোগ

ডা. মাফরুহা আক্তার রুমানা : 

১৭ এপ্রিল, বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ঃ Access for all বা সকলের জন্য অধিগম্যতা, সকলের জন্য চিকিৎসা। এখনও সারা বিশ্বে ৭৫% হিমোফিলিয়া রোগি সনাক্তের বাহিরে আছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশ গুলতে। সকলের জন্য সনাক্তকরন সুবিধা সুনিশ্চিত করা।

# কেস এক: ছয় বছরের একটি ছেলের সুন্নত ই খতনা করার পর কিছুতেই রক্তপাত কমছে না। দ্রুত ঢাকাতে আনার পর কয়েক ব্যাগ রক্ত দেয়া হল। হেমাটোলজিস্ট কে দেখানোর পর পরীক্ষা নীরিক্ষার পর হিমোফিলিয়া A ধরা পড়ল।

# কেস দুই : হিমোফিলিয়াA আক্রান্ত একটি ছেলে মাঝে মাঝে inj FVIII নেয়। তার হাঁটু দুটোই অর্ধেক ক্ষমতা সম্পন্ন।  এবার আবারো হাঁটু ফুলেছে। তবে আর ফ্যাক্টর কাজ করছে না। তার inhibitor বা এন্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। এখন যে চিকিৎসা লাগবে তা বেশ ব্যায়বহুল যা তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়।

হিমোফিলিয়া কী?

হিমোফিলিয়া রক্তের একটি বিশেষ জন্মগত বা জীনগত রোগ যেখানে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। আমাদের শরীরে কোথাও কেটে গেলে সাধারণত কিছুক্ষন পর স্বাভাবিক ভাবে রক্তজমাট বেঁধে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্ত হিমোফিলিয়া রোগির এই রক্তক্ষরণ দীর্ঘসময়ের জন্য চলতে থাকে। কারন রক্ত জমাট বাঁধার জন্য যে বিশেষ প্রোটিন FVIII ও FIX প্রয়োজন হয় তার ঘাটতি থাকে। এই দুইটি ফ্যাক্টরের জীন মানুষের এক্স ক্রোমোজমে থাকে। 

জানা যায়, উনিশ শতকের শুরুতে  বৃটিশ রাজপরিবারের রাণী ভিক্টোরিয়া ছিলেন হিমোফিলিয়া জীনের বাহক। তার পুত্র সন্তান লিওপোল্ডের ছিল অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ রোগ যা পরবর্তীতে বংশপরম্পরায় চলতে থাকে। তার উত্তরসূরীদের বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে ইউরোপ ও রাশিয়ার রাজপরিবারেও এই জীন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালে বৃটিশ রাজপরিবারের স্টিফেন ক্রিসমাস একই ধরনের হিমোফিলিয়া বি রোগে আক্রান্ত হন। তাই তখন এটিকে রয়েল ডিজিজ বলা হত।
আজ বিশ্বের সব দেশেই এই রোগ দেখা যায়।

কাদের হয়? কেন হয় ?

সাধারণত ছেলেরা আক্রান্ত হয়, আর মেয়েরা এই হিমোফিলিয়া জীনের বাহক হয়। কারন বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় X- linked disease যা শুধুমাত্র এক্স ক্রোমোজমের মাধ্যমে বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। ছেলেদের একটি মাত্র এক্স ক্রোমোজম থাকে যা মায়ের কাছ থেকে আসে। তাই মা যদি তার এক্স ক্রোমোজমে  এই ত্রুটিপূর্ণ জীন বহন করে তবে তার পুত্র সন্তানরা হিমোফিলিয়া আক্রান্ত হতে পারে। মেয়ে সন্তানরা বাহক হতে পারে। এই ক্ষেত্রে জীনেটিক ত্রুটির কারনে রক্ত জমাট বাঁধার প্রোটিন বা ফ্যাক্টর( FVIII or FIX) স্বাভাবিক এর চেয়ে অনেক কম থাকে। তাই রোগির বেশি ও দীর্ঘ রক্ত ক্ষরণ হয়। 

পারিবারিক ইতিহাস খুব গুরুত্বপূর্ণ, আক্রান্তের খালাত ভাই, মামা, নানা এদের ইতিহাস জানা জরুরী । তবে ২৫% ক্ষেত্রে কোন পারিবারিক ইতিহাস নাও থাকতে পারে, অর্থাৎ নতুন মিউটেশন থেকেও হতে পারে।

হিমোফিলিয়ার ধরন ও লক্ষণঃ

সাধারনত দুই ধরনের হয়। যেমন : 

* হিমোফিলিয়া A : FVIII এর ঘাটতি

* হিমোফিলিয়া B : FIX এর ঘাটতি

রোগের তীব্রতা ও ফ্যাক্টর এর মাত্রা অনুযায়ী এদেরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমনঃ

• মৃদু/ Mild: ফ্যাক্টর মাত্রা >৫-৪০%। এদের তেমন কোন উপসর্গ থাকে না। তবে কোথাও কেটে গেলে বা আঘাত পেলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়।

• মাঝারি/ Moderate: ফ্যাক্টর মাত্রা ১-৫%। মাঝে মাঝে মাংসপেশি, হাড়ের জয়েন্ট ও অন্যান্য টিস্যু তে রক্তক্ষরণ হয়। 

• মারাত্মক/ Severe: ফ্যাক্টর মাত্রা < ১%। এখানে কোন রকম আঘাত ছাড়াই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে। জন্মের পর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও হতে পারে। এছাড়াও মাংসপেশি, হাড়ের জয়েন্ট বিশেষত হাঁটু, কুনুই,পায়ের গোড়ালি এসব স্থানে ফুলে যেতে পারে ও ব্যথা হয়।জয়েন্ট ফুলে গিয়ে গরম হয়ে তীব্র ব্যথা হতে পারে। ত্বকের নীচে আঘাত বা bruise, মাড়ি দিয়ে রক্তক্ষরণ এসবও হতে পারে। মারাত্মক ক্ষেত্রে শিশু অবস্থাতেই লক্ষণ প্রকাশ পায়।

এছাড়াও দাঁত পড়া, সুন্নাত-ই-খতনা, যেকোন সার্জারি বা আঘাত এর কারনে অতিরিক্ত রক্ত পড়তে পারে।

হিমোফিলিয়াতে মূল সমস্যা হল হাড়জোড়া বা জয়েন্ট ফুলে যাওয়া যাকে বলা হয় hemarthrosis/arthropathy. একই জয়েন্ট বারে বারে ফুলে গিয়ে টার্গেট জয়েন্টে পরিনত হয়। ফলে তার কার্যকারিতা কমে যায়।এতে রোগির  হাঁটা ও চলাফেরা বিঘ্নিত হয়।একসময় জয়েন্টের কাজ সম্পূর্ণরূপে ব্যহত হতে পারে।

সনাক্তকরণঃ

যথাযথ ইতিহাস ও লক্ষণ জানার পর রক্তের স্ক্রীনিং পরীক্ষার মাধ্যমে ধারনা করা যায় যে APTT নামক পরীক্ষার ফল বেশি। এর পরে নির্দিষ্ট ফ্যাক্টর পরীক্ষা( Factor VIII or IX Assay)করে হিমোফিলিয়া রোগ নির্ধারণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এই পরীক্ষাগুলো করা হয়।

চিকিৎসাঃ 

• ফ্যাক্টর ইঞ্জেকশন ( FVIII or FIX concentrate replacement).

• প্লাজমা পরিসঞ্চালন ( Fresh frozen Plasma or cryoprecipitate)

• রক্ত পরিসঞ্চালন ক্ষেত্র বিশেষে।

• ইনহিবিটর বা এন্টিবডি সনাক্তকরন ও জটিলতার চিকিৎসা 

বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসা : 

• আক্রান্ত স্থানকে বিশ্রাম দেয়া ও সম্ভব হলে উঁচু করে রাখা

• রক্তক্ষরণের স্থানকে চেপে ধরে রাখা

• দ্রুত বরফ বা ঠান্ডা পানি দেয়া

• ব্যথা হলে প্যারাসিটামল খাওয়া

• হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এর পরামর্শ নেয়া।

শেষ কথাঃ

বাংলাদেশে আনুমানিক বিশ হাজারের বেশি হিমোফিলিয়া রোগি থাকার কথা। কিন্তু মাত্র আনুমানিক ২২০০ রোগি নিবন্ধিত হয়েছে।বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটি রোগি সনাক্তকরন সহ সচেতনতা মূলক বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আরো বেশি সচেতনতা, সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।  

ডা. মাফরুহা আক্তার রুমানা
এফসিপিএস (হেমাটোলজি)
সহকারি অধ্যাপক
হেমাটোলজি বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ। 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল