আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাতের পর অন্য দুই প্রতিবেশী চীন ও আফগানিস্তানের দিকে আরও বেশি করে ঝুঁকছে পাকিস্তান। চলতে সপ্তাহে নেওয়া কূটনৈতিক উদ্যোগ ইসলামাবাদ ও কাবুলের মধ্যে প্রায় চার বছর পর আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পথ খুলে দিতে পারে।
২১ মে বেইজিংয়ে একটি ফোরামের অধীনে এক 'অনানুষ্ঠানিক' ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। এই ফোরামের যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালে এবং সর্বশেষ বৈঠক হয় ২০২৩ সালের মে মাসে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-র ভাষ্যমতে, এবারের বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হচ্ছে গত কয়েক বছরের উত্তেজনার পর কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান উভয় পক্ষই।
'আফগানিস্তান ও পাকিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের স্পষ্ট ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং নীতিগতভাবে যত দ্রুত সম্ভব রাষ্ট্রদূত বিনিময়ে সম্মত হয়েছে। চীন এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানায় এবং আফগান-পাক সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়তা অব্যাহত রাখবে,' বলেন ওয়াং।
তিনি আরও বলেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বিআরআই) আওতাধীন ৬২ বিলিয়ন ডলারের মেগা প্রকল্প চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) এখন আফগানিস্তান পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে।
আলোচনা সম্পর্কে অবগত একজন পাকিস্তানি কূটনীতিক আল জাজিরাকে জানান, বেইজিং বৈঠকের গতি ধরে রেখে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, 'খুব শিগগিরই' এই ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের পরবর্তী পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, 'আমি ফলাফল নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী। এই বৈঠক তিন দেশের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস তৈরির একটি চমৎকার প্রচেষ্টা ছিল।'
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার ছায়ায় ত্রিপাক্ষিক কূটনীতি
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চারদিনের সঙ্ঘারের পরই এই বৈঠক হলো। এ সংঘাতে দুই দেশই নিজেদের 'জয়ী' দাবি করে আধিপত্য বাড়ানোর লক্ষ্যে কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে শুরু করে।
৭ থেকে ১০ মে পর্যন্ত চলা এই সংঘর্ষের সূত্রপাত ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত মাসে ঘটে যাওয়া হামলার জেরে। ওই সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে; যদিও ইসলামাবাদ এ অভিযোগ অস্বীকার করে।
চীন দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানালেও সংঘাতের ময়দানে পাকিস্তানের প্রতি তাদের সমর্থন স্পষ্ট ছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চীনা যুদ্ধবিমান, মিসাইল ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে।
অন্যদিকে ১৫ মে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে এক আলোচনায় পেহেলগাম হামলার 'নিন্দা' জানানোয় তিনি আফগানিস্তানকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। ভারতীয় গণমাধ্যম আরও জানায়, মে মাসের শুরুতে তালেবান সরকারের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইব্রাহিম সদর দিল্লি সফর করেন।
ইসলামাবাদভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক পাকিস্তান-চীন ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফা হায়দার সাঈদ বেইজিং বৈঠককে 'অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ' বলে অভিহিত করেন, বিশেষ করে আফগানিস্তানের ভৌগোলিক সংবেদনশীলতা বিবেচনায়।
সাঈদ বলেন, ভারতের সঙ্গে এই সংঘাত পাকিস্তান ও চীনের জন্য আফগানিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
কাবুলভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তামীম বাহিসও এ বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, মুত্তাকি-জয়শঙ্কর আলোচনা ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, যা ইসলামাবাদকে উদ্বিগ্ন করে তুলতে পারে।
তামীম বাহিস আরও বলেন, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ভূরাজনীতিতে নতুন গতিপথ তৈরি হচ্ছে। এই বাস্তবতায় বেইজিংয়ের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকটি শুধু বিষয়বস্তু নয়, সময় নির্বাচনের কারণেও এই তিন দেশের সমন্বয়ের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
অম্ল-মধুর সম্পর্ক
২০২১ সালের আগস্টে আফগান তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর অনেকেই একে পাকিস্তানের জন্য বিজয় হিসেবে দেখেছিল—বিশেষ করে তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে। ১৯৯৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তালেবানের অন্যতম প্রধান মিত্র ছিল পাকিস্তান। অন্যদিকে, ভারত তালেবানকে বরাবরই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রক্সি হিসেবে দেখেছে এবং তাদের সঙ্গে কোনোরকম সংলাপেও যেতে চায়নি।
তবে সময়ের সঙ্গে পাকিস্তান ও তালেবানের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।
পাকিস্তান অভিযোগ করেছে, আফগান তালেবান সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান-এর (টিটিপি) মতো গোষ্ঠীগুলোকে হামলা চালাতে দিচ্ছে। তালেবান অবশ্য এই অভিযোগ তীব্রভাবে অস্বীকার করেছে। ২০০৭ সালে গঠিত টিটিপির সঙ্গে আফগান তালেবানের আদর্শগত মিল থাকলেও তারা স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হয়।
পাক ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে পাকিস্তানে ৫২১টি হামলা হয়েছে—যা আগের বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি। এসব হামলায় প্রায় এক হাজার বেসামরিক মানুষ ও নিরাপত্তা কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।
তবু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অচলাবস্থা ভাঙার ইঙ্গিত নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ১৯ এপ্রিল কাবুল সফরে যান—পেহেলগাম হামলার ঠিক কয়েকদিন আগেই।
ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইহসানুল্লাহ টিপু বলেন, আফগানিস্তানের পাকিস্তানের কূটনৈতিক পুনঃস্থাপনের উদ্যোগে নিরাপত্তা উদ্বেগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বাণিজ্য, সীমান্ত বিরোধ কিংবা সীমান্ত বন্ধের চেয়েও তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চীনও এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
'অর্থবহ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে পাকিস্তানের নিরাপত্তা উদ্বেগ আগে সমাধান করতে হবে,' আল জাজিরাকে বলেন টিপু। তিনি সতর্ক করেন, এই ইস্যু এড়িয়ে গেলে তা সশস্ত্র সংঘর্ষেও রূপ নিতে পারে।
'তবে চীনের বৈশ্বিক প্রভাব আর পাকিস্তান ও আফগানিস্তান—উভয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় বেইজিং যেকোনো প্রতিশ্রুতির কার্যকর গ্যারান্টিদাতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে,' যোগ করেন তিনি।
শত্রু যখন এক
পাকিস্তান অভিযোগ করছে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালানো যোদ্ধাদের আশ্রয় দিচ্ছে আফগান তালেবান। তবে এসব হামলার অনেকগুলোতেই সিপিইসি প্রকল্পে কর্মরত চীনা নাগরিকদের টার্গেট করা হয়েছে।
পাকিস্তান সরকারের হিসাবে, দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার চীনা নাগরিক বাস করছে। ২০২১ সাল থেকে খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তানের মতো প্রদেশে অন্তত ২০ জন চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন। টিটিপিসহ বেশ কিছু গোষ্ঠী এসব হামলার দায় স্বীকার করেছে।
চীনও ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের অভিযোগ, এ গোষ্ঠীর যোদ্ধারা আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে চীনের বিরুদ্ধে হামলা চালায়।
পাকিস্তান-চীন ইনস্টিটিউটের সাঈদ বলেন, আফগানিস্তান-সংক্রান্ত বিষয়ে পাকিস্তান ও চীনের কাছে নিরাপত্তাই 'মূল স্বার্থ'।
তিনি বলেন, দুপক্ষের জন্যই এটি হুমকি। অতীতে আফগানিস্তানে ইটিআইএমের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। তাই যেকোনো ধরনের সহযোগিতার পূর্বশর্ত হচ্ছে প্রথমে আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেঁড়ে বসা এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে নিষ্ক্রিয় করা।
তবে বিশ্লেষক তামীম বাহিস বলেন, তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর চীনসহ অধিকাংশ আঞ্চলিক দেশ আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে 'গ্রহণযোগ্য' মনে করছে, যা অর্থনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে।
'একটি বড় ব্যতিক্রম হচ্ছে পাকিস্তান, যেটি এখনও আফগান ভূখণ্ড থেকে আসা গুরুতর নিরাপত্তা হুমকির মুখোমুখি,' বলেন তিনি। 'পাকিস্তানের প্রধান অগ্রাধিকার হলো টিটিপিকে নির্মূল করা বা নিয়ন্ত্রণে আনা। কিন্তু কাবুলের মনোযোগ এখন বাণিজ্য, ট্রানজিট ও আঞ্চলিক সংযুক্তির দিকে।'
এই জায়গাতেই চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দৃশ্যপটে হাজির হতে পারে বলে মনে করেন কাবুলভিত্তিক এই বিশ্লেষক। তিনি বলেন, চীনই একমাত্র দেশ যা একযোগে নিরাপত্তা সহযোগিতা উৎসাহিত করার পাশাপাশি তিন দেশের জন্য লাভজনক বাণিজ্য ও যোগাযোগ প্রকল্পগুলোকেও এগিয়ে নিতে পারে।
ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্ক ও পাকিস্তানের উদ্বেগ
২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের বেসামরিক সরকারগুলোর শাসনামলে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যদিও তালেবান ও তাদের মিত্ররা একাধিকবার ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনে হামলা করে।
গত কয়েক মাসে কাবুল ও নয়াদিল্লির কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জয়শঙ্কর-মুত্তাকির সাম্প্রতিক আলোচনাও।
এই ঘনিষ্ঠতা কি ইসলামাবাদে উদ্বেগ তৈরি করেছে? সাঈদ তা মনে করেন না।
তিনি বলেন, 'পাকিস্তান কাবুলকে অবিশ্বাস করে না। তবে পাকিস্তান বাস্তব পদক্ষেপ চেয়েছে। টিটিপি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিয়ে কাবুল যা বলছে, তা কাজেও দেখাতে হবে। আমি মনে করি না বেইজিং বা ইসলামাবাদ কেউই কাবুল ও ভারতের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্কের বিরোধিতা করে—যতক্ষণ না সেটা পাকিস্তান বা চীনের স্বার্থে আঘাত করে।'
তবে বাহিস ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, তালেবানের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা পাকিস্তান ও চীনে উদ্বেগ তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে এই দুই দেশের অতীতের ভারত-বিরোধী অবস্থানের প্রেক্ষাপটে।