আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
রাশিয়া সোমবার (২ জুন) শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনকে জানিয়েছে, যুদ্ধ থামাতে হলে কিয়েভকে নতুন করে বড় অংশের ভূখণ্ড ছাড়তে হবে এবং সেনাবাহিনীর আকার ছোট করতে হবে—রুশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক স্মারকে এসব বলা হয়েছে।
ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ওই আলোচনায় রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে এ শর্তগুলো তোলে। এতে বোঝা যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প 'রক্তপাত' থামানোর আহ্বান জানালেও রাশিয়া তাদের পুরোনো লক্ষ্য থেকে সরে আসছে না।
ইউক্রেন এই প্রস্তাবকে আবারও 'আত্মসমর্পণের শামিল' বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রায় দুই বছর পর দ্বিতীয়বারের মতো আলোচনায় বসে যুদ্ধরত দুই দেশের প্রতিনিধিরা। এক ঘণ্টার বৈঠকে যুদ্ধবন্দি বিনিময়ে একমত হয় তারা—বিশেষ করে অল্পবয়সী ও মারাত্মক আহত বন্দিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ১২ হাজার মৃত সেনার মরদেহ ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান এই বৈঠককে 'উল্লেখযোগ্য' বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি জানান, ট্রাম্পকে সঙ্গে নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তুরস্কে একই টেবিলে বসাতে চান।
তবে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো চাপ দিলেও মস্কো জানিয়েছে, তারা কেবল দীর্ঘমেয়াদি সমাধান চায়, সাময়িক বিরতি নয়। কিয়েভের দাবি, 'পুতিনের মধ্যে শান্তির কোনো আগ্রহ নেই'।
ট্রাম্প হুঁশিয়ার করে বলেন, দুই পক্ষ সমঝোতার দিকে না এগোলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতা থেকে সরে আসবে।
ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুস্তেম উমেরভ। তিনি জানান, ইউক্রেন একটি নিজস্ব 'শান্তি রোডম্যাপ' তৈরি করেছে এবং রাশিয়ার প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করবে। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি।
উমেরভ জানান, ইউক্রেন জুনের মধ্যেই আরও একটি বৈঠক চায়। তবে কিয়েভ মনে করে, জটিল বিষয়ে মীমাংসা সম্ভব কেবল জেলেনস্কি ও পুতিনের সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে।
জেলেনস্কি বলেন, 'রাশিয়ায় অপহৃত ৪০০ শিশুর তালিকা দিয়েছি আমরা, অথচ রুশপক্ষ মাত্র ১০ জনকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছে।' রাশিয়ার দাবি, এসব শিশু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে 'নিরাপত্তার জন্য' সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
রাশিয়ার শর্ত
ইন্টারফ্যাক্সে প্রকাশিত স্মারকে রাশিয়া বলেছে, যুদ্ধের নিষ্পত্তির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া এবং ইউক্রেনের আরও চারটি অঞ্চলকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ইউক্রেনকে এসব এলাকা থেকে সেনা সরাতে হবে।
এছাড়া, ইউক্রেনকে 'নিরপেক্ষ রাষ্ট্র' হিসেবে গড়ে তুলতে হবে—অর্থাৎ ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। রুশ ভাষাকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে, রুশভাষীদের অধিকার রক্ষা করতে হবে এবং 'নাজিবাদকে গৌরবজনকভাবে বর্ণনা' নিষিদ্ধ করতে হবে।
ইউক্রেন এসব দাবিকে 'অযৌক্তিক' বলে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বলেছে, তারা কখনও রুশভাষীদের প্রতি বৈষম্য করে না।
শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে রাশিয়া এবার অস্ত্রবিরতিরও দুটি বিকল্প শর্ত উপস্থাপন করেছে, যা ইউক্রেনের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা কম।
প্রথম বিকল্প অনুযায়ী, ইউক্রেনকে লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসন অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ সেনা সরাতে হবে। এর মধ্যে রাশিয়া লুহানস্ক পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখলেও বাকি তিন অঞ্চলের প্রায় ৭০ শতাংশ এখন তাদের হাতে।
দ্বিতীয় বিকল্প অনুযায়ী, ইউক্রেনকে নতুন করে সেনা মোতায়েন বন্ধ করতে হবে, বিদেশি সামরিক সহায়তা ও গোয়েন্দা তথ্য নেওয়া বন্ধ করতে হবে এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার করে ১০০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন করতে হবে।
রুশ প্রতিনিধিদলের প্রধান ভ্লাদিমির মেদিনস্কি বলেন, কিছু ফ্রন্টলাইনে দুই-তিন দিনের জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবও দিয়েছে রাশিয়া, যেন নিহত সেনাদের মরদেহ উদ্ধার করা যায়।
এদিকে, ইউক্রেনের নিজস্ব শান্তি রূপরেখার একটি অনুলিপি রয়টার্স হাতে পেয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, কিয়েভ চায় যুদ্ধ শেষ হলেও তাদের সামরিক সক্ষমতার ওপর কোনো সীমা না থাকুক। ইউক্রেন আরও চায়, দখলকৃত অঞ্চলগুলোর ওপর রাশিয়ার দাবি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি না পাক এবং ক্ষতিপূরণ আদায় হোক।
রুশ বোমারু বহরে ইউক্রেনের হামলা
মে মাসে রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর সবচেয়ে বড় ড্রোন হামলা চালিয়েছে এবং ছয় মাসে প্রথমবার সবচেয়ে দ্রুত অগ্রসর হয়েছে। এর মধ্যেই ইউক্রেন রোববার 'স্পাইডারস ওয়েব' নামে বিশেষ অভিযানে ১১৭টি ড্রোন পাঠিয়েছে সাইবেরিয়া ও উত্তর রাশিয়ার বিমানঘাঁটিতে, যেখানে পরমাণু অস্ত্রবাহী দীর্ঘপাল্লার বোমারু বিমান রাখা থাকে।
স্যাটেলাইট চিত্রে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আভাস মিলেছে, তবে দুই পক্ষ ক্ষতির মাত্রা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে চালানো এই হামলা ইউক্রেনের অন্যতম সাহসী পদক্ষেপ।
রাশিয়ার কৌশলগত বোমারু বিমান বহর দেশটির 'পারমাণবিক ত্রয়ী'র অংশ—যার মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে উঠেছে।
পুতিনের পক্ষ থেকে এই পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে বারবার হুমকির পর, যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো এমন পদক্ষেপে শুরু থেকেই সতর্ক।
এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই হামলার আগে ট্রাম্প বা হোয়াইট হাউসকে কিছু জানানো হয়নি। সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, অপারেশন নিরাপত্তার জন্য ইউক্রেন সাধারণত এ ধরনের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রকে জানায় না। এক ব্রিটিশ কর্মকর্তাও বলেন, যুক্তরাজ্যকে আগাম কিছু জানানো হয়নি।
জেলেনস্কি বলেন, কাঠের শেডে লুকানো ড্রোন দিয়ে চালানো অভিযানে মিত্রদের আস্থা ফিরেছে।
তিনি আরও বলেন, 'ইউক্রেন জানিয়ে দিয়েছে, আমরা আত্মসমর্পণ করব না, কোনো শর্ত মানব না। তবে আমরা যুদ্ধ চাই না, শক্তি দেখাতে চাই না—শত্রু থামছে না বলেই আমাদের শক্তি দেখাতে হচ্ছে।'