মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন থেকে ইতিহাস বদলে দেওয়া এক অগ্নিঝরা জুলাই

মঙ্গলবার, জুলাই ১, ২০২৫
চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন থেকে ইতিহাস বদলে দেওয়া এক অগ্নিঝরা জুলাই

নিজস্ব প্রতিবেদক:

২০২৪ সালের ২ জুলাই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নাটকীয় বাঁক আসে। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে একটি নতুন ব্যানারে জড়ো হয়েছিলেন টিএসসিতে। দাবি ছিল—সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালের বিজ্ঞপ্তি পুনর্বহাল করতে হবে। এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। ঢাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, বরিশাল, ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়—সবখানে গর্জে ওঠে শিক্ষার্থীরা।

৪ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের কোটা-বিষয়ক রায় বহাল রাখে। এরপর শিক্ষার্থীরা ৬ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ৭ জুলাই ঢাকা শহর কার্যত স্থবির হয়ে যায়। শেখ হাসিনা আন্দোলনকে অযৌক্তিক বলে আখ্যা দেন এবং বলেন, বিষয়টি আদালতেই নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।

৮ জুলাই থেকে আন্দোলন আরও ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার সঙ্গে বিভিন্ন জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। শিক্ষার্থীরা একটি মাত্র দাবি তুলে ধরেন—অন্যায্য কোটা বাতিল করতে হবে। ১০ জুলাই আপিল বিভাগ চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দিলেও আন্দোলন থামেনি। শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট জানান—সংসদে আইন পাস ছাড়া আন্দোলন চলবে। ১১ জুলাই হাইকোর্ট বলে, কোটা পূরণ না হলে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া যাবে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা আইন ছাড়া কোনো পরিবর্তন মানবেন না।

১২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শাহবাগ। সাবেক আইনমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, সরকার ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। ১৩ জুলাই রাজশাহীতে রেলপথ অবরোধ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়—মামলা দিয়ে আন্দোলন ঠেকানো হচ্ছে।

১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিতে যায় শিক্ষার্থীরা। সেদিন শেখ হাসিনার এক মন্তব্যে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতি-নাতনি বলে উল্লেখ করা হয়। এই মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় বিভিন্ন ক্যাম্পাসে। ওঠে নতুন স্লোগান—‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার।’

১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের নেতারা স্লোগানে ‘রাজাকার’ শব্দ ব্যবহারের নিন্দা করেন। ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের শাস্তির হুমকি দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ঢামেকেও হামলা হয়। এদিন আহত হন তিন শতাধিক।

১৬ জুলাই সংঘর্ষে ৬ জন নিহত হন। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা হয়। শিক্ষার্থীদের হল খালি করতে বলা হয়। ছয়টি জেলায় মোতায়েন করা হয় বিজিবি। রংপুরে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে আবু সাঈদকে। এই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়।

১৭ জুলাই গায়েবানা জানাজার সময় পুলিশ হামলা চালায়। এরপর দেশজুড়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করা হয়। জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ রাখতে বলা হয়। শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দেন।

১৮ জুলাই কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ হামলা চালায়। ১৯টি জেলায় সংঘর্ষে নিহত হন কমপক্ষে ২৯ জন। বন্ধ হয় মেট্রোরেল, বন্ধ হয় মোবাইল ইন্টারনেট। বিটিভি, সেতু ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ হয়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজায় আগুন লাগে।

১৯ জুলাই সংঘর্ষে আরও ৬৬ জন নিহত হন। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হয় তীব্র সংঘর্ষ। আন্দোলনকারীরা নয় দফা দাবি দেন—প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমা চাইতে হবে, মন্ত্রী ও ভিসিদের পদত্যাগ করতে হবে, ছাত্রলীগ-পুলিশের হামলায় জড়িতদের বিচার করতে হবে, ক্ষতিপূরণ ও নিরাপত্তা দিতে হবে।

২০ জুলাই সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে, সেনা নামায়। ২১ জন নিহত হন। দুই দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়। আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলামকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। ২১ জুলাই পাওয়া যায় তার ক্ষতবিক্ষত দেহ।

২১ জুলাই সর্বোচ্চ আদালত সরকারি চাকরিতে নতুন করে কোটা নির্ধারণ করে—মেধা ৯৩%, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ৫%, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ১%, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ ১%। কিন্তু আন্দোলন থামেনি।

২২ জুলাই ১ হাজার ৪২৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়, প্রায় ২০ হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে ৫০টি মামলা হয়। বিএনপি-জামায়াতের শত শত নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। ২৩ জুলাই সরকার ৯৩ শতাংশ মেধা ভিত্তিক নিয়োগের ঘোষণা দেয়। আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন।

২৪ জুলাই তিনজন সমন্বয়কারীকে পাওয়া যায়। তারা জানান, তুলে নিয়ে নির্যাতন করে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। ২৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেল স্টেশন পরিদর্শন করেন, আহতদের না দেখে আরও ক্ষোভ জন্মায়।

২৬ জুলাই ডিবি হাসপাতাল থেকে আন্দোলনের ছয় নেতা তুলে নেয়। বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলনে যোগ দেয়। ২৭ জুলাই ‘ব্লক রেইড’ শুরু হয়। ছয়জনকে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ নেওয়া হয়।

২৮ জুলাই সারাদেশে ২০০টি মামলায় ২ লাখ ১৩ হাজার মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়। ডিবি হেফাজতে থাকা ছয় নেতার খাওয়ার ছবি ভাইরাল হয়। পরে বিবৃতি দিয়ে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন তারা। কিন্তু বাইরের সংগঠকরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। সরকার জানায়, আন্দোলনে ১৪৭ জন নিহত হয়েছেন।

২৯ জুলাই ফের রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ৩০ জুলাই সরকার নিহতদের স্মরণে শোক পালনের ঘোষণা দেয়। আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করে লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তুলে প্রতিবাদ জানান।

৩১ জুলাই ‘জাস্টিস ফর মার্চ’ কর্মসূচি ঘোষণা হয়। হাইকোর্টে আইনজীবী ও শিক্ষকরা অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীরা হুঁশিয়ারি দেন—বন্দিদের মুক্তি না পেলে এইচএসসি পরীক্ষা বর্জন করবেন।

১ আগস্ট সরকার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে। জাতিসংঘ ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং টিম পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। শেখ হাসিনা তাতে সম্মতি দেন। এদিন ছয় সমন্বয়কারীকে মুক্তি দেওয়া হয়। শহীদদের স্মরণে মিছিল হয়।

২ আগস্ট ফের সংঘর্ষে নিহত হন আরও দুইজন। ‘দ্রোহ যাত্রা’ কর্মসূচিতে লাখো মানুষ অংশ নেয়। ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে হাজারো মানুষের জমায়েত হয়। পুলিশের হামলা অব্যাহত থাকে।

৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে সহিংসতায় ৯৩ জন নিহত হন। মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে হামলা শুরু হয়। ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির তারিখ এগিয়ে আনা হয়।

৫ আগস্ট হাজারো মানুষ কারফিউ ভেঙে ঢাকায় প্রবেশের চেষ্টা করেন। দুপুর পর্যন্ত সংঘর্ষ চলে। দুপুরে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। শেখ হাসিনা পদত্যাগে রাজি হন। এরপর তিনি ভারতে পালিয়ে যান।

ঢাকা শহর চলে যায় জনতার নিয়ন্ত্রণে। শুরু হয় বিজয় উৎসব। তবে, সহিংসতায় আরও অনেকে প্রাণ হারান।

এখনও হয়নি শহীদদের তালিকা, চিকিৎসা বঞ্চিত আহতরা
আন্দোলনে জীবন দিয়েছে বহু মানুষ। আহত হয়েছেন হাজার হাজার। কিন্তু এক বছর পরও শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি হয়নি। আহতদেরও সঠিক তালিকা নেই। অনেক আহত এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কেউ কেউ বলছেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও পাচ্ছেন না।

জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন জানায়, এখন পর্যন্ত তাদের তালিকায় ১৫,৩৯৩ জন আহত এবং ৮৫৪ জন নিহত। তবে ধারণা করা হয়, আরও অনেক নাম বাদ পড়েছে। অনেক শহীদের লাশ ঢাকার বিভিন্ন কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এখনও পড়ে আছে ছয়জনের মরদেহ। এখনও কোনো সুরাহা হয়নি।

ফাউন্ডেশনের বিশেষ সেলের প্রধান মো. মশিউর রহমান বলেন, এখনো চূড়ান্ত তালিকা তৈরি হয়নি। নতুন করে আরও ১৫–২০ জনের নাম গেজেটে যুক্ত করা হবে। আহতদের নাম চূড়ান্ত করতে আরও সময় লাগবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস সার্ভারে নাম এন্ট্রি বন্ধ থাকায় অনেক আবেদন পেন্ডিং। উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া নতুন নাম নেওয়া সম্ভব না। তবে যাদের ভাতা দেওয়া হবে, তারা জুলাই থেকে হিসেব পাবেন। ভাতা আগস্ট থেকে চালু হলেও জুলাই–আগস্ট একসঙ্গে পাবেন।

ফাউন্ডেশন জানায়, গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে আহত ও নিহতদের পরিবারকে ১১০ কোটি টাকার সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আহতদের চিকিৎসা ও কর্মসংস্থান, শহীদ পরিবারের চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। পুনর্বাসন কর্মসূচিও চলমান।

শহীদদের নামে গেজেট প্রকাশ, বৃক্ষরোপণ, স্মৃতিফলক স্থাপন এবং জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো হবে। ৫ আগস্ট আয়োজন করা হবে বড় স্মরণসভা। এছাড়াও অজ্ঞাত শহীদদের শনাক্তে বিশেষ সেল গঠন এবং এমআইএস যাচাইকৃত তালিকা তৈরির কাজ চলছে।

এমআই


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল