মুহাম্মদ মুসা খান:
গত ২৩ আগস্ট কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছর যেতে না যেতেই পরাজিত শক্তির নানা ষড়যন্ত্রের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।’ রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, মতপার্থক্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যকে আরও দৃশ্যমান করা দরকার।’ প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে যদি ঐক্য না থাকে, তাহলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমেছিলেন এবং হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন- সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। কারণ তাদের অনৈক্যের সুযোগে পরাজিত স্বৈরাচার আবারও মাথা চড়া দিয়ে উঠতে পারে। স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা কখনও নিশ্চিন্ন হয়ে যায় না।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভূরাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, “বাংলাদেশ একটি বিভক্ত জাতি—এটি ধর্ম, অর্থনীতি ও সামাজিক শ্রেণীবিভাগের দিক থেকে চরম বৈষম্যপূর্ণ—এটা বুঝতে কোনো গবেষণার দরকার নেই।”
স্মরণ করা যেতে পারে যে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এই সরকারের এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিমুক্ত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের যে স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল, অনেকেরই অভিযোগ - সেই স্বপ্ন এখন ফিকে হতে বসেছে ।
তাঁরা মনে করছেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির মধ্যে বিভেদ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। সংঘাত-সংঘর্ষের পথে এগোচ্ছে। তাই জুলাই অভ্যুত্থানের অর্জন বা প্রাপ্তি নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।’ অন্তর্বর্তী সরকার- গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, দেশ পরিচালনা এবং রাজনীতিকে শুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে নানামুখী সংস্কারের কাজ হাতে নিয়েছিলো , কিন্তু সেখানেও বিস্তর মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা কাম্য ছিলো না।
একথা স্বীকার্য যে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসকের বিদায় হয়েছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ‘দীর্ঘস্থায়ী ঐক্যবদ্ধ লড়াই’ ও ‘রাষ্ট্রীয় অপরাজনীতির আমূল পরিবর্তন করে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চিরকালের জন্য উচ্ছেদ করতে হবে।’ ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নির্মাণ এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এ জন্য ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে বলে জানিয়েছেন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই হিসেবে বলা যায়, এ সরকারের মেয়াদ আর বাকি আছে এক বছরের কম সময়। কিন্তু এর মধ্যেই সংস্কারের বিভিন্ন প্রস্তাব তৈরি হচ্ছে । সরকারের হাতে যে সময় আছে, সেই সময়ের মধ্যে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের বলেই মনে করেন অনেকে।
সংস্কার নিয়ে অন্তত তিনটি চ্যালেঞ্জ এখন প্রবলভাবে দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি করা। কমিশন রিপোর্ট দিলে অন্তর্বর্তী সরকার সেটা নিয়ে সরাসরি বাস্তবায়নে নামতে পারবে না। সুতরাং সংস্কার প্রস্তাব হাতে এলেও শেষ পর্যন্ত সংস্কার কোন কোন খাতে, কীভাবে হবে -তা নিয়ে ঐক্যমতে আসতে হবে । দ্বিতীয়ত, সংস্কার ব্যাপকভাবে হবে নাকি স্বল্পপরিসরে হবে সেটা নিয়েও দলগুলোর সঙ্গে সরকারকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। তৃতীয়ত, ‘সংস্কার’ এ সরকার করবে নাকি নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার করবে -এ বিষয়গুলো নিয়েও আছে নানা মত।
এদিকে জাতীয় নির্বাচন নিয়েও রয়েছে দ্বিধাবিভক্তি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে। অন্যদিকে জামায়াতসহ অন্যান্য কিছু দল সংস্কারের পর নির্বাচন চাচ্ছে। ফলে স্পষ্ট হচ্ছে নতুন নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণও। জামায়াতে ইসলামীসহ জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদসহ ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী’ ডান ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ‘সংখ্যানুপাতিক (পিআর)'’ পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনের ইস্যুতে এক হলেও ভিন্নমত পোষণ করে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো। বলা যায়- পিআর পদ্ধতি ও সংস্কারপ্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হচ্ছে। ‘পিআর পদ্ধতিকে আসলেই প্রকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বলা যায় না।'’ এই পদ্ধতির সাথে আমাদের দেশের প্রচলিত সরাসরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মিল নাই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসবে—এই বিভাজন আরো বাড়বে। রাজনীতিতে ভিন্নমত স্বাভাবিক, কিন্তু কোনো পক্ষের ‘পূরণযোগ্য নয়’ এমন দাবি- পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। কিছুদিন আগে জুলাই আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী আয়োজিত আলোচনাসভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রশ্ন তোলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো একটি অংশের সহায়তায় দেশে কেউ উদ্দেশ্যমূলক বা বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে কি না!’ সে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
তারেক জিয়ার মন্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম বলেন, “জনাব তারেক জিয়া ঠিকও হতে পারেন, ভুলও হতে পারেন। তবে যখন ক্ষমতার লোভ ক্ষমতালোভীদের মধ্যে চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন এমন পরিস্থিতি খুব স্বাভাবিক। আমি বিশ্বাস করি, যদি নির্বাচনের তারিখ (যদি আদৌ হয়) সামনে আসে, তাহলে রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হবেই।”
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, ‘একটি ভ্রান্ত ধারণা থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং এই সংস্কারপ্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট করে তুলেছে।’’ ড. শাহদিন মালিকের মন্তব্য ‘সঠিক নয়’ বলে আমরা মনে করি। কারণ দীর্ঘ তিন দশকের অধিক সময় ধরে রাজনৈতিক সরকার গুলো ক্ষমতায় থেকে দূর্নীতি ও দখলদারিত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। দদলীয়করণ চুড়ান্ত করেছে। বিগত তিন নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। ফলে ‘সংস্কার বিহীন নির্বাচন’- বাংলাদেশকে আবারও দূর্নীতিবাজদের হাতে তুলে দিতে পারে বলে আমরা মনে করি। ‘সংস্কার বিভাজন তৈরি করেছে’- এমন অভিযোগ না তুলে, আমরা বরং ‘সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার’ আহ্বান জানাতে পারি। আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, সেটা হলো - ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অর্জনকে ধরে রাখতে হবে।’ লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্য অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির ‘ঐক্য’ অত্যন্ত জরুরি। আমরা মনে করি, জনপ্রত্যাশা বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে এগিয়ে যাবে। এ দেশের মানুষও এটাই প্রত্যাশা করে। সংস্কারের মাধ্যমে দেশে আবার নতুন করে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হবে এবং ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুদৃঢ় হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য। নিশ্চিত হবে সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি।
হাঁ, আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন সময় গণআন্দোলনের হাত ধরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যেখানে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা চিন্তা করা প্রয়োজন, সেখানে বিভাজন, হানাহানি, মারামারিসহ প্রতিহিংসাপরায়ণতাই যেনো প্রাধান্য পাচ্ছে । কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে জাতীয় ঐক্যকে গুরুত্ব না দেওয়ায় দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা বারংবার তার সুযোগ গ্রহণ করে । সেই বিভক্তির জেরে দশকের পর দশক সেই সকল দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক- সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি বারংবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লক্ষ্য অর্জনের পর বিজয়ী শক্তির প্রথম কর্তব্য থাকে , দেশে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যকে সংহত করা। এর অর্থ এই নয় যে, যাহারা খুন-গুম-ধর্ষণ, লুটপাট, মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থপাচার ইত্যাদি গুরুতর অন্যায়-অপকর্মের সাথে জড়িত ছিল- তাদের সকলকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। বরং তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আবশ্যক। স্বাধীনতা লাভের পর অর্ধশতাব্দীকাল অতিবাহিত হলেও এখনো স্বাধীনতার সুফল পাননি- বলে অনেকে আক্ষেপ করেন। দেশ যেনো আজ বহুধা বিভক্ত। ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়া এক শ্রেণির মানুষের এজেন্ডা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে আমাদের সমাজে আমরা ঐক্য দেখেছি। ঐক্য বেড়ে উঠেছিলো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন হয়েছে। বায়ান্ন, উনসত্তর, একাত্তরে আমাদের ঐক্য ছিল অবিস্মরণীয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিপক্ষ ছিল নিষ্ঠুর; নির্যাতন ছিল নির্মম। কিন্তু ঐক্য ভাঙেনি, বরং এর দৃঢ়তাই অধিকতর স্পষ্ট হয়েছে।
কিন্তু বর্তমান পর্যায়ে আমরা কিছুটা ব্যতিক্রম দেখছি। কোন কোন ক্ষেত্রে কাঁদা ছোড়াছুড়িও দেখা যাচ্ছে। এ দেশে এখনও ষড়যন্ত্রকারিরা সক্রিয়। জুলাই বিপ্লবকে ব্যর্থ করার জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাঁরা হাজার কোটি টাকার বাজেট তৈরি করেছে। সুতরাং সংস্কার পরবর্তী সময়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এদেশকে- দূর্নীতি মুক্ত, চাঁদাবাজমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, সমৃদ্ধ-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে উত্তরণের লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে ব্যক্তিস্বার্থ বাদ দিয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সর্বদলীয় জাতীয় ঐক্য তুলতে হবে।
লেখক : মুহাম্মদ মুসা খান কলামিস্ট, রাজনীতি বিশ্লেষক ও সমাজকর্মী।