লেখক: মুহাম্মদ তাওফিকুল হাসান
নাফির শরীরের প্রায় ৯৫% পুড়ে গেছে। সম্পূর্ণরুপে আগের অবস্থায় কখনো ফিরতেও পারবেনা। পরবর্তীতে ৯০% দগ্ধ হওয়া নাজিয়াকেও উদ্ধার করা হয়। দু'জনের কাউকেই ঠিকভাবে চিনতে পারছিলোনা নুহান। দগ্ধ হওয়া দু'ভাই-বোনকে রেখে নুহান নিজেকে কোনোভাবে সামলে পুনরায় আহমদকে খুজতে নেমে পড়ে।
ওইদিকে নুহানের পিছনে লেগে আছে মিডিয়ার লোকেদের তুমুল ভীড়। তাদের জনসমাগমের কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি মাঠে ঢুকতে পারছেনা। যথাসময়ে মাঠে গাড়ি না আসায় আগুনের দাবানল ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।
নুহান দেখতে পায় তার কাছের আরও কয়েকজন সহপাঠী আগুনে ঝলসাতে ঝলসাতে কাতরাচ্ছে। ছোট্ট নুহান সাহস করে সামনে এগোলেও, এগোচ্ছে না মিডিয়ার তথাকথিত সাহসী যোদ্ধারা। নিজের জীবন বাজি রেখে তারা ব্যস্ত ফুটেজ সংগ্রহে। কয়েকজনতো খুঁজে খুঁজে পুড়ে যাওয়া লাশের ছবি বিভিন্ন এঙ্গেলে তুলছেন।
দুঃখিত; তারা তখনো লাশ হয়নি। মিডিয়ার সাহসী যোদ্ধারা তখন ফুটেজ সংগ্রহ না করে যদি আহতদের উদ্ধারে নেমে পড়তো, তাহলে লিখনিতে হয়ত অনেকটা পরিবর্তন আসত; উপরের লাইনগুলোর শব্দচয়নও ব্যতিক্রম হতো।
কিন্তু মূল দোষ সাংবাদিকদের কিভাবে দেই বলেন! নিউজ চ্যানেলগুলোর দর্শকেরাও তখন দিনদুনিয়া ভুলে আপডেট খবর পেতে ব্যস্ত। শোকাহত, ব্যথিত দর্শকেরা ফেসবুকের টাইমলাইনে পোস্ট শেয়ার না করে থাকতে পারছেননা। তাদের তীব্র আকাঙ্খার কারণেই হয়ত চ্যানেলগুলো সাংবাদিকদের সাহসী যোদ্ধার খেতাবটি দিয়েছে।
কয়েকজন সত্যিকারের মানুষ জীবনের মায়া ত্যাগ করে নেমে যায় উদ্ধার কার্যে। ঘটনাস্থল থেকে আহতদের অনতিবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জরুরী। দূর থেকে শুনতে পাওয়া যায় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন।
সাইরেনের শব্দ দূর থেকে শোনা গেলেও, কাছে গিয়ে দেখা মিলে কিছু বিভৎস ব্যক্তিত্বের। একের পর এক পোড়া রোগী আসায়, মূহুর্তের মাঝে অ্যাম্বুলেন্সসহ, জরুরী কাজে নিয়োজিত যানবাহনের ভাড়া তিনগুণ থেকে চারগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। গুটিকয়েক লোকজন আহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসলেও, জরুরী ভিত্তিতে তাদের পক্ষে কাছের কোনো মেডিকেল বা হাসপাতালগুলোতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। অটোরিকশা থেকে সি.এনজি চালক সবাই তখন নিজেদের আখের জোগাড়ে মগ্ন।
অনেক্ষণ ধরে ছোটাছুটি করায় নিউজ রিপোর্টার ইয়াছিরের তীব্র পানির পিপাসা পায়। কিছু সময় খোজাখুজির পর একজনকে দেখা গেলো পানির বোতল হাতে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেসা করলে, দাম শুনে হকচকিয়ে যায় ইয়াছির। প্রতি লিটার পানির বোতলের দাম চাওয়া হচ্ছে ৬০০৳; বাঙালি জাতির চিরচেনা রূপ ফুটে ওঠে তার সামনে। আরও কিছুক্ষণ খোঁজাখুজির পর, শেষমেশ ২০০৳ দিয়ে এক লিটার পানি কিনে তৃষ্ণা মিটায় ইয়াছির। তৃষ্ণা মিটে পুনরায় তার দায়িত্ব পালনে নেমে পড়েন।
অন্যদিকে আহমদের বাবার অফিসের কাজকর্ম শেষ হতে কিছুটা দেরি হলেও, ছেলের জন্মদিনের কথা তিনি ভুলেননি। দোকান থেকে আহমদের পছন্দের গাড়িটি কিনেই চলে আসেন ক্যাম্পাসে। কিন্তু আজ মনেনয় একটু বেশিই দেরি হয়ে গেলো। আগুনের ভয়াবহতার দৃশ্য দেখে আহমদের বাবা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। বুকের উপর চাপা পাথর সরিয়ে, নেমে পড়েন আহমদকে খুজতে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেও আহমদের কোনো সন্ধান মিলে না।
সারাদিন কাজের চাপে আহমদের মায়ের আর টেলিভিশন দেখা হয়নি। বিকেলের দিকে আহমদের নানা কল করে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করলে, বাড়িতে দেরি না করে তিনি তৎক্ষনাৎ স্কুলে ছুটে চলে যান।
আজ ঘটনার এক সপ্তাহ পূর্ণ হলো। এরই মাঝে ফেসবুক টাইমলাইনসহ আমাদের চিন্তা থেকে বিদায় নিয়েছে "মাইলস্টোন ট্রাজেডি"। শোক ভুলে জীবন-জীবিকার তাগিতে দেশের মানুষজন আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদের নিত্যদিনের কাজকর্মে। প্রতিদিনকার মতো আমরা হয়ত আবারও হাসছি, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠছি। দুনিয়ার ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে পড়েছি...
কিন্তু আহতদের পরিবারের দিকে কি আমরা লক্ষ্য করেছি?
তাদের দিন কিভাবে পার হচ্ছে তা একবারও কল্পনা করেছি?
নাফি-নাজিয়ার দু'জনের একজনও যে আর পৃথিবীতে নেই, তা কি শুনেছি?
একসাথে দু'সন্তান হারিয়ে নিসন্তান হয়ে যাওয়া তাদের পিতামাতার দিকে তাকিয়েছি?
আহমদের বাবা-মা এখনো যে হাসাপাতাল থেকে মর্গে ছোটাছুটি করছে, তা কি জানতে পেরেছি?
আদৌ আহমদ বেঁচে আছে, নাকি আগুন অঙ্গার হয়ে গেছে তার কি সঠিক উত্তর দিতে পেরেছি?
বিবাহের দশ বছর পর আসা একমাত্র সন্তানের আকস্মিক মৃত্যুতে, একটা ছোট্ট পরিবার কিভাবে নিঃশেষ হয়ে যায় তা কি কখনো ভেবে দেখেছি?
মনুষ্যত্ব হারিয়ে একটা জাতি কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তা কি কখনো ভাবতে পেরেছি?
এ জাতির সংষ্কারও যে সম্ভব তা নিয়ে কেউ কি চিন্তা করেছি?
নিজের আত্ম-সংষ্কার যে অতীব দরকার তা নিয়ে কখনো ভেবে দেখেছি?
মুহাম্মদ তাওফিকুল হাসান
শিক্ষার্থী,
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি