বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫

ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করতে গুনতে হবে ৩৮ হাজার কোটি টাকা

বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১৪, ২০২৫
ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করতে গুনতে হবে ৩৮ হাজার কোটি টাকা

সময় জার্নাল ডেস্ক:

দেশের দুর্বল ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সংকট কাটাতে বড় ধরনের একীভূতকরণ পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে মোট ৩৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। যার মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত করতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা আর ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণে ব্যয় হতে পারে ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর স্পষ্ট করেছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শুধু তারল্য সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা আনার জন্য একীভূতকরণের পথে এগোনো হচ্ছে।

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোকে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। একীভূতকরণের মাধ্যমে এ খাতকে পুনর্গঠন করা গেলে আমানতকারীর স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে এবং সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী হবে।

বিশ্বের অনেক দেশেই সরকার দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণে বিনিয়োগ করেছে এবং পরবর্তীতে লাভসহ সেই অর্থ ফেরত নিয়েছে। বাংলাদেশেও একই মডেল অনুসরণ করা হবে। সরকার বিনিয়োগ করলে তা ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে।- গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর

বর্তমানে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক একীভূতকরণের আলোচনায় রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য, আগামী অক্টোবরের মধ্যে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। তবে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকা এক্সিম ব্যাংক চাইলে একীভূতকরণ থেকে সরে দাঁড়াতে পারবে, সেক্ষেত্রে তাদের সিআরআর, এসএলআর এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ধারের আট হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পদ মূল্যায়নে পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এরমধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট ঋণের ৯৭ দশমিক ৮০ শতাংশ খেলাপি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬২ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

এ উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের ব্যাংকিং খাত শুধু সংকট থেকে বেরিয়ে আসবে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে আরও স্থিতিশীল ও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে।- আশা বাংলাদেশ ব্যাংকের

এসব ব্যাংকের মূলধন, প্রভিশন এবং তারল্য ঘাটতি এতটাই তীব্র যে, তারা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারের ওপর নির্ভর করছে।

অর্থ উপদেষ্টা সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করার গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং দ্রুত প্রস্তাব প্রস্তুতের নির্দেশ দেন। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ প্রক্রিয়ার আওতায় আনার ইঙ্গিত দেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠিয়েছে, যেখানে প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ, শেয়ার ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়ার ধাপগুলো বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।

‘একীভূত হলেও আমানত নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত থাকবে। সরকার আমানতকারীদের দায়িত্ব নেবে। কবে নাগাদ কোন ব্যাংক কার সঙ্গে একীভূত হবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। তবে আমানতকারীদের এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। সবাই টাকা ফেরত পাবেন’

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশেই সরকার দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণে বিনিয়োগ করেছে এবং পরবর্তীতে লাভসহ সেই অর্থ ফেরত নিয়েছে। বাংলাদেশেও একই মডেল অনুসরণ করা হবে। সরকার বিনিয়োগ করলে তা ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে।’

তিনি জানান, আপাতত দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য সরাসরি তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে না। বরং একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাঠামোগত সংস্কার করে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করা হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও, পরবর্তী ধাপে আরও ১০-১৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ প্রক্রিয়ার আওতায় আসতে পারে।

এ উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের ব্যাংকিং খাত শুধু সংকট থেকে বেরিয়ে আসবে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে আরও স্থিতিশীল ও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গভর্নর ড. মনসুর ইঙ্গিত দিয়েছেন, আগামীতে ১৫ থেকে ২০টি ব্যাংক একীভূতকরণের আওতায় আনা হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, আপাতত পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত (মার্জার) করার আলোচনা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বাকি ১১টি ব্যাংক নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি, পরে তা নির্ধারণ করা হবে।

বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা—সাধারণত পুরনো কর্মীদের রাখার শর্তে ব্যাংকগুলো রাজি হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে জোরপূর্বক মার্জার বাস্তবায়ন করতে পারে। যা হতে পারে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষার শেষ চেষ্টা।- এম হেলাল আহমেদ জনি

তিনি বলেন, পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় সম্পদ মূল্যায়ন, শেয়ার ইস্যু এবং অন্যান্য কারিগরি ও নীতিনির্ধারণী বিষয় সমাধানের কাজ চলছে। আইনগত জটিলতাও কেটে গেছে। বর্তমানে এমন আইন কার্যকর রয়েছে, যার মাধ্যমে যেকোনো ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা সম্ভব। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মূল ভিত্তি হবে আর্থিক সূচক (ফিনান্সিয়াল ইন্ডিকেটর), যা দেখে বোঝা যায় কোনো ব্যাংক এককভাবে পরিচালনা চালিয়ে যেতে সক্ষম নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করার ভার সরকার এ মুহূর্তে বহন করতে পারবে না। আবার সরকার তারল্য দিয়ে সবাইকে বাঁচিয়ে রাখতেও পারবে না, তাদের নিজেদের দাঁড়াতে হবে। কারণ, প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো অর্থ লাগবে।’

‘এক্ষেত্রে শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করতে হলে প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। আর ব্যাংকের ক্ষেত্রে আরও প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো লাগবে। তবে প্রাথমিকভাবে পাঁচটি ব্যাংকের একীভূত হতে পারে খুব দ্রুতই’- বলেন এ কর্মকর্তা।

প্রথম ধাপে ইসলামী ধারায় পরিচালিত পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কারণ এ ব্যাংকগুলো একই নীতিমালা অনুসরণ করে। প্রাথমিক পরিকল্পনায় মোট ২০টি ব্যাংককে ধাপে ধাপে একীভূত করার কথা রয়েছে—প্রথম ধাপে ৬-৭টি এবং দ্বিতীয় ধাপে আরও ১১-১২টি ব্যাংক একীভূত করা হবে। তবে সবার ক্ষেত্রে একই সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য না-ও হতে পারে; বিশ্লেষণ শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

একীভূতকরণের জন্য কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হবে, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। তবে অর্থ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, প্রয়োজনে সরকার অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করবে। তিনি দুর্বল ব্যাংকের মতো ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে এবং দ্রুত প্রস্তাব প্রস্তুত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।

গভর্নর ড. মনসুর বলেছেন, ব্যাংক একীভূতকরণের আলোচনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এতে আমানত নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত থাকবে। সরকার আমানতকারীদের দায়িত্ব নেবে। কবে নাগাদ কোন ব্যাংক কার সঙ্গে একীভূত হবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। তবে আমানতকারীদের এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। সবাই টাকা ফেরত পাবেন।

অর্থনীতিবিদদের মতে, দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া হলেও আমানতকারীদের জন্য ভালো। গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম হেলাল আহমেদ জনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতের একটি প্রতিষ্ঠান দুর্বল হলে পুরো খাত ঝুঁকিতে পড়ে যায়। আর এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার একটিই উপায় হলো মার্জার (একীভূতকরণ)।’

তিনি বলেন, ‘বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা—অধিগ্রহণকারী ব্যাংক কি বিদ্যমান কর্মীদের রাখবে নাকি পুনর্গঠন করবে। সাধারণত পুরনো কর্মীদের রাখার শর্তে ব্যাংকগুলো রাজি হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে জোরপূর্বক মার্জার বাস্তবায়ন করতে পারে। যা হতে পারে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষার শেষ চেষ্টা।’

‘কোনো ব্যাংক রাজি না হলে সেই ব্যাংক বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন (দ্রুত সংশোধনমূলক পদক্ষেপ) ফ্রেমওয়ার্কে এনে ব্যালান্স শিট ঠিক করতে বলা হতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক এটি সমন্বয় করবে এক্ষেত্রে আমানতকারীরাও নিরাপদ, শেয়ার পাবেন সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা’- যোগ করেন এম হেলাল আহমেদ জনি।

একে 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল