জাকারিয়া শেখ, ফুলবাড়ী(কুড়িগ্রাম)সংবাদদাতা:
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার চর গোড়ক মন্ডল। একসময় ধরলা নদীর আশীর্বাদে গড়ে ওঠা এ জনপদ আজ মৃত্যুঘণ্টায় পরিণত হয়েছে। নদী ছিল জীবিকা, কৃষি আর যাতায়াতের ভরসা। কিন্তু এখন সেই ধরলাই গ্রাস করছে বসতবাড়ি, ফসলি জমি, স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দিরসহ সবকিছু। ভিটেমাটি হারিয়ে মানুষ দিশেহারা। স্থানীয়দের চোখে ভেসে ওঠে একটাই প্রশ্ন— “আমরা কোথায় যাবো?”
গত সপ্তাহে পানি কমতে শুরু করলে আবারও ভয়াবহ ভাঙন দেখা দেয়। প্রতিদিন নদীর স্রোতে ভেঙে পড়ছে ঘরবাড়ি, গাছপালা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দিগন্তজোড়া জনবসতি ধীরে ধীরে নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। অথচ কার্যকর কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি।
৭২ বছরের প্রবীণ আবদুল মান্নান ভাঙনের দুঃসহ স্মৃতি বলতে গিয়ে ভেঙে পড়েন। কাঁপা গলায় তিনি জানান— “গত বছর ভাঙনে বসতবাড়ি হারালাম। অনেক কষ্টে নতুন ঘর তুললাম, কিন্তু কয়েকদিন আগে সেটিও নদীতে বিলীন হলো। জীবনের শেষ বয়সে পথে বসতে হবে, কখনো ভাবিনি।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিবছর বরাদ্দের আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে কোনো টেকসই উদ্যোগ নেই। কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে, কেউ রাস্তার পাশে, আবার কেউ শহরের বস্তিতে গিয়ে ঠাঁই নিচ্ছেন। শীতে খোলা আকাশের নিচে শীতার্ত রাত, বর্ষায় মাথার উপর ছাদহীন জীবন— যেন অভিশাপ হয়ে নেমে আসে। শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ে, নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটান।
নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হাছেন আলী জানান— “গত বর্ষায় প্রায় একটি গ্রাম ও আধা কিলোমিটার সড়ক ধরলার ভাঙনে নদীতে বিলীন হয়েছে। শত শত একর আবাদি জমি হারিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ছয়-সাত হাজার জিওব্যাগ ফেলেছিল, কিন্তু ভাঙন ঠেকানো যায়নি। বর্তমানে অন্তত ৫০০ পরিবার সরাসরি হুমকির মুখে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান স্বীকার করেন, “নদীর স্রোত এতই তীব্র যে স্থায়ী বাঁধ ছাড়া ভাঙন রোধ সম্ভব নয়। গত বছর সাত হাজার জিওব্যাগ ফেলা হয়েছিল, কিন্তু তা টেকসই সমাধান নয়। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অন্যদিকে, ভাঙনে দিশেহারা মানুষ শুক্রবার (২২ আগস্ট) সকালে চর গোড়ক মন্ডলে এক বিশাল মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু সবাই মিলে তারা ঘণ্টাব্যাপী এই মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে একটাই দাবি তুলেছেন— “আমরা আশ্রয় চাই না, চাই টেকসই বাঁধ।” কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এরকম মানববন্ধন বারবার হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
চরবাসীর অভিযোগ, জিওব্যাগ ফেলে অস্থায়ী সমাধান দিয়ে বছরের পর বছর সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। কিন্তু নদীকে বশে আনার একমাত্র উপায় হলো বিজ্ঞানসম্মত ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ। অন্যথায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চর গোড়ক মন্ডল মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।
ধরলার ভয়াবহ ভাঙন আজ শুধু ভৌগোলিক সংকট নয়, এটি এক মানবিক বিপর্যয়। জীবনের শেষ সম্বল হারানো মানুষের আর্তনাদ আজ সবার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে— “আমরা আশ্রয় চাই না, চাই টেকসই বাঁধ।”
এমআই