দুলাল বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ:
প্রত্যন্ত এক গ্রামের তরুণী লিপি খানম (২৮)। ছোটবেলায় তার বাবা মারা যান। বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক। দারিদ্রতা, বঞ্চনা আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুরু হয় লিপির জীবন। একসময় জীবিকার তাগিদে বাড়ি বাইরে গিয়ে কিছু করায় অনেকে তাকে নিয়ে সমালোচনাও করতেন। মা ফাতেমা বেগমের সংসারে কষ্টে বেড়ে ওঠে লিপি। জীবনে তার তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ছিল শুধু সংগ্রাম।
আর্থিক অভাব আর সামাজিক বঞ্চনার সঙ্গে লড়াই করে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ফলসি ফুকরা গ্রামের লিপি খানম আজ হাজারো নারীর অনুপ্রেরণা। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সারা দেশে তৈরি করছেন হাজার হাজার ‘নারী উদ্যোক্তা’। লিপির সফলতার গল্প আজ শুধু তার গ্রামের গর্ব নয়, গোটা বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়নের অনন্য উদাহরণ।
২০১৬ সালে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা সমবায় অফিসের মাধ্যমে পাঁচ দিনের একটি প্রশিক্ষণ নেন লিপি। সেখান থেকেই শুরু হয় তার আত্মনির্ভরশীলতার যাত্রা। এরপর নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ‘ফুকরা পল্লী উন্নয়ন হস্ত ও কারুশিল্প সমবায় সমিতির সদস্য হন তিনি। ওই সমিতির আওতায় গ্রামের ৪০ জন নারীকে ব্লক-বাটিকের ওপর প্রশিক্ষণ দেন। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি লিপি। একে একে সমবায় অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বিসিক এবং জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) থেকে নিয়েছেন প্রায় ৩০টি মতো প্রশিক্ষণ। নিজের দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি তিনি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছেন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। বর্তমান তিনি বাংলাদেশ সমবায় একাডেমি এবং দেশের ১০টি জোনাল অফিসের অধীনে ৬৪ জেলায় ব্লক-বাটিক, স্ক্রিন প্রিন্ট, হ্যান্ড প্রিন্ট, ট্রেইলারিং এবং বুটিক (ফ্যাশন) প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন।
তার হাত ধরে কয়েক হাজার নারী আজ আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন। গড়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা হিসাবে। যারা এক সময় গৃহিণী ছিলেন, ঘর থেকে বের হওয়ার সাহসও পাননি। আজ তারা নিজেরাই উপার্জন করছেন। সংসারে ফিরে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা।
এক সময় গ্রামের মানুষ লিপিকে ভিন্ন চোখে দেখত। নারীদের নিয়ে কাজ করায় নানা কটূক্তির শিকার হয়েছেন তিনি। কিন্তু আজ সেই লিপিই গ্রামের গর্ব। তিনি শুধু একজন প্রশিক্ষক নন, তিনি একজন ‘নারী উদ্যোক্তা তৈরির কারিগর’। তার সফলতা রাষ্ট্রীয়ভাবেও স্বীকৃত। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের ‘জয়িতা’ পুরস্কার, জেলার শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা এবং শ্রেষ্ঠ সংগঠকসহ পেয়েছেন একাধিক সম্মাননা।
লিপি খানম প্রমাণ করেছেন-ইচ্ছা, মেধা ও পরিশ্রম থাকলে অভাব কখনো বাধা হতে পারে না। আজ তিনি শুধু নিজেকে নয়, গড়ে তুলেছেন হাজারো লিপি। তার স্বপ্ন, প্রতিটি নারী হবে স্বাবলম্বী। আর প্রতিটি পরিবার হবে স্বপ্নময়।
লিপি খানম বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করি। দুই ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম বড়। মেয়ে হয়েও আমাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। একদিকে সংসারের টানাপোড়ন, অন্যদিকে নিজের লেখাপড়া। তবুও শত বাধা পেরিয়ে অভাব-অনটনের মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে যাই। এরপর উপজেলা সমবায় কার্যালয় থেকে মাত্র পাঁচ দিনের একটা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। ওই প্রশিক্ষণ আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। প্রশিক্ষণ শুধু শেখা নয়। এটা নিজেকে চিনে নেওয়ার পথ। এরপর বিভিন্ন দপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। শিখেছি ব্লক-বাটিক, স্ক্রিন প্রিন্ট, বুটিক, সেলাইসহ আরও অনেক কিছু।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার সফলতার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান তৎকালীন কাশিয়ানী উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আব্দুর রহমান স্যারের। স্যারের অনুপ্রেরণায় এখন আমি শুধু নিজে স্বাবলম্বী নই। সমবায় অধিদপ্তরের অধীনে দেশব্যাপী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তা তৈরি করছি। ভবিষ্যতে আমি দেশসেরা নারী উদ্যোক্তা প্রশিক্ষক হতে চাই।’
নারীদের উদ্দেশ্য করে লিপি বলেন, ‘প্রত্যেক নারী যদি দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করে। তাহলে নিজের কর্মসংস্থান নিজে তৈরি করতে পারে। এখন তথ্য প্রযুক্তির যুগ। প্রশিক্ষণ নিয়ে ঘরে বসেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা সম্ভব। অনেক তরুণ-তরুণী অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়া কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছে। আয় করছেন লাখ লাখ টাকা। নিজ ও পরিবারের আর্থিক চাহিদা পূরণ করে সঞ্চয় করছেন। ক্ষুদ্র উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে সফল হচ্ছেন অনেকে।’
এমআই