আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে নতুন ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে দেশটির সংসদ। তাকে গ্রেপ্তার ও বিচার থেকে আজীবন দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এই পদক্ষেপের ফলে দেশটিতে স্বৈরতন্ত্রের পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সই হওয়া ২৭তম এই সাংবিধানিক সংশোধনীটি দেশের শীর্ষ আদালতগুলোর পরিচালনা পদ্ধতিতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে।
এই পরিবর্তনের পক্ষের ব্যক্তিরা বলছেন, এটি সশস্ত্র বাহিনীকে একটি সুস্পষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো দেবে এবং আদালতগুলোর মামলাজট কমাতে সাহায্য করবে।
পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে আসছে। কখনও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরাসরি ক্ষমতা দখল করেছে, আবার কখনও পর্দার আড়াল থেকে ক্ষমতার কলকাঠি নেড়েছে। পাকিস্তানের ইতিহাসে বেসামরিক স্বায়ত্তশাসন এবং জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ও জেনারেল জিয়া-উল-হকের মতো সামরিক নেতাদের প্রকাশ্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। বিশ্লেষকরা বেসামরিক ও সামরিক শক্তির এই ভারসাম্যকে 'হাইব্রিড শাসন' বলে থাকেন।
অনেকেই এই সংশোধনীকে সামরিক বাহিনীর দিকে ক্ষমতার ভারসাম্য ঝুঁকে পড়ার একটি বড় লক্ষণ হিসেবে দেখছেন।
'আমার কাছে এই সংশোধনীটি সর্বশেষ এবং সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী ইঙ্গিত যে, পাকিস্তান এখন হাইব্রিড নয়, বরং পোস্ট-হাইব্রিড ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে,' বলেন ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। 'আমরা এমন একটি পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছি যেখানে বেসামরিক-সামরিক ভারসাম্যহীনতা যতটা সম্ভব চরমে পৌঁছেছে।'
সর্বশেষ এই সংশোধনীর ফলে ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্বে থাকা আসিম মুনির এখন থেকে পাকিস্তানের নৌ ও বিমান বাহিনীকেও তত্ত্বাবধান করবেন। তার ফিল্ড মার্শাল পদ এবং ইউনিফর্ম আজীবনের জন্য বহাল থাকবে। এমনকি অবসরের পরেও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে বিভিন্ন 'দায়িত্ব ও কর্তব্য' দেওয়া হবে।
ধারণা করা হচ্ছে যে, এই সিদ্ধান্তের কারণে, তিনি আজীবন জনপরিসরে কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবেন।
বিলটির সমর্থকরা যুক্তি দিয়েছেন, এটি পাকিস্তানের সামরিক কমান্ড কাঠামোকে আরও স্পষ্ট করবে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি) প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, আধুনিক যুদ্ধের চাহিদা মেটাতে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর বৃহত্তর সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে।
তবে মানবাধিকারকর্মী এবং সাংবাদিক মুনিজা জাহাঙ্গীর বলেন, 'সামরিক ও বেসামরিক লোকদের মধ্যে কোনো ভারসাম্য নেই। তারা ক্ষমতার ভারসাম্য আবার সামরিক বাহিনীর দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়েছে এবং এমন এক সময়ে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছে যখন তাদের লাগাম টেনে ধরা দরকার ছিল।'
বিচার বিভাগে বড় পরিবর্তন
এই সংশোধনীর আওতায় একটি নতুন ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত গঠন করা হবে, যা সাংবিধানিক প্রশ্নগুলোর নিষ্পত্তি করবে। এই আদালতের প্রথম প্রধান বিচারপতি এবং অন্য বিচারপতিদের নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের কো-চেয়ার মুনিজা জাহাঙ্গীর বলেন, 'এটি সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার অধিকারের ধরন এবং প্রকৃতিকে চিরতরে বদলে দেবে।'
তার মতে, রাষ্ট্র যখন বেঞ্চ গঠন নির্ধারণ করে দেয়, তখন বিচারপ্রার্থী হিসেবে সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার আশা থাকে না।
সাংবাদিক ও ভাষ্যকার আরিফা নূর বলেন, 'বিচার বিভাগ এখন নির্বাহী বিভাগের বেশ অধীনস্থ হয়ে পড়েছে। সাধারণ ধারণাটি হলো, বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে কাজ করার আর কোনো সুযোগ থাকবে না।'
এই সংশোধনীর আগে সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক মামলাগুলোর শুনানি ও নিষ্পত্তি করত। কেউ কেউ বলছেন, এতে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার জট তৈরি হতো। তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাউদ্দিন আহমেদ এই যুক্তিকে 'লোকদেখানো' বলে অভিহিত করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে পাকিস্তানে বিচারাধীন বেশিরভাগ মামলাই সুপ্রিম কোর্টে নেই।
সংশোধনীটি আইনে পরিণত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি পদত্যাগ করেন। বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ তার পদত্যাগপত্রে লেখেন, 'আমি যে সংবিধান রক্ষা করার শপথ নিয়েছিলাম, তা আর নেই।' আরেক বিচারপতি মনসুর আলি শাহ বলেন, বিচার বিভাগকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে এবং ২৭তম সংশোধনী 'সুপ্রিম কোর্টকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।'
প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ এই পদত্যাগের বিষয়ে বলেন, 'তাদের বিবেক জাগ্রত হয়েছে কারণ সুপ্রিম কোর্টে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব করা হয়েছে এবং সংসদ সংবিধানের আধিপত্য প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে।'
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, বিচারপতিদের তাদের সম্মতি ছাড়াই বিভিন্ন আদালতে বদলি করা যাবে। বদলিতে রাজি না হলে তারা জুডিশিয়াল কমিশনে আপিল করতে পারবেন এবং কারণটি অগ্রহণযোগ্য মনে হলে বিচারপতিকে অবসরে যেতে হবে।
আইনজীবী সালাউদ্দিন আহমেদ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, 'এই পরিবর্তনটি বিচারপতিদের ওপর সরকারের কথামতো চলার জন্য চাপ সৃষ্টি করবে।'
মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, 'চাপা ক্ষোভ সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য ভালো লক্ষণ নয়।'
আরিফা নূর বলেন, 'এটি স্বৈরাচারবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার ইঙ্গিত দেয়।' তিনি মনে করেন, এই সংশোধনীটি গত বছর করা ২৬তম সংশোধনীর ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যা আইনপ্রণেতাদের দেশের শীর্ষ বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা দিয়েছিল। এরই মধ্যে ২৮তম সংশোধনীরও গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
এমআই