নিজস্ব প্রতিবেদক:
অবশেষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন। গতকাল শুক্রবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে এ কথা জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার এক দিন পর তারেক রহমানের দেশে ফেরার কথা জানালেন তিনি।
মা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন মিলিয়ে তারেক রহমান দেশে ফেরার এ সিদ্ধান্ত নেন। বর্তমানে খালেদা জিয়া চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারছেন বলে জানিয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরছেন। তিনি দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে বিদেশের মাটিতে রয়েছেন, প্রায় এক যুগ ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, গণতান্ত্রিক উত্থানে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দলের পক্ষ থেকে শুধু নয়, আনন্দের সঙ্গে গোটা জাতিকে এটা জানাচ্ছি।’
২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় চিকিৎসার জন্য স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান ও মেয়ে জাইমা রহমানকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনে যান তারেক রহমান। ওই সময় থেকে লন্ডনে অবস্থান করছেন। লন্ডনে থেকেই তিনি বিএনপিকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। দেশে ফিরে গুলশানের দুই বাসায় থাকবেন।
গত নভেম্বরের শেষ দিকে খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি ও তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির পরও তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, তিনি দ্রুতই দেশে ফিরছেন। এই প্রেক্ষাপটে লন্ডন থেকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন তারেক রহমান। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘এমন সংকটকালে মায়ের স্নেহ-স্পর্শ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যে কোনো সন্তানের মতো আমারও রয়েছে। কিন্তু অন্য আর সবার মতো এটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।’
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্র উত্তরণের পথে যত বাধা, তারেক রহমান দেশে এসে পৌঁছালে তা দূর হয়ে যাবে। গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের যে ট্রেন চলতে শুরু করেছে; যে আশা-প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ।
দলের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, দেশে ফিরলে তারেক রহমানকে বিশেষ নিরাপত্তা দেবে সরকার– এমন নিশ্চয়তা পেয়েছে বিএনপি। দেশে ফেরার পর তিনি গুলশানের ফিরোজা ও পাশে আরেকটি বাসায় থাকবেন। এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তারেক রহমান চাইলে ভ্রমণ পাস দেওয়া হবে।
উচ্ছ্বসিত নেতাকর্মী স্বাগত জানাতে প্রস্তুত
দীর্ঘ দেড় যুগ পর প্রিয় নেতাকে বরণ করতে ২৫ ডিসেম্বর ইতিহাস সৃষ্টি করতে উদ্যোগ নিয়েছেন দলের নেতাকর্মীরা। তাদের প্রত্যাশা, ওই দিন ঢাকার বিমানবন্দরে জনতার ঢল নামবে। নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ জনগণ তাঁকে স্বাগত জানাতে আসবেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক সমকালকে বলেন, তারেক রহমান এখন আর শুধু বিএনপির নেতা নন, তিনি সর্বজনীন নেতা, জনমানুষের নেতা। তাঁর ফেরার দিন ইতিহাস সৃষ্টি হবে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন বলেন, দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে চাই। নেতাকর্মীদের এদিন ঘরে রাখা যাবে না। এটা আবেগের জায়গা। সবাই এদিন বিমানবন্দরে ছুটবেন তাদের প্রিয় নেতাকে একনজর দেখার জন্য।
তারেক রহমান ১৯৮৮ সালে ২২ বছর বয়সে বগুড়া জেলার গাবতলী থানা বিএনপির সদস্য হন। আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনে যোগ দেওয়ার আগেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তারেক রহমান তাঁর মা খালেদা জিয়ার সহচর হিসেবে সারাদেশে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও মায়ের পাশাপাশি তারেক রহমান দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণা চালান। এই নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনীতির প্রথম সারিতে তাঁর সক্রিয় আগমন ঘটে। ২০০২ সালে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এর পরই দেশব্যাপী দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেন। একজন দক্ষ সংগঠক ও সক্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর এই সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে বিরোধী পক্ষ অপপ্রচার শুরু করে, যা ভিত্তিহীন ছিল।
২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় তারেক রহমানকে কারাগারে যেতে হয়, র্নিযাতনের শিকার হতে হয়। এক পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য তাঁকে ২০০৮ সালে লন্ডনেও যেতে হয়। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে তিনি দল পরিচালনায় সম্পৃক্ত হতে থাকেন। সারাদেশে নেতাকর্মীদের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। তাদের সব সমস্যায়, মামলা-হামলা-নির্যাতনে পাশে দাঁড়ানোর মূল ভূমিকা পালন করতে থাকেন। আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন উচ্চ আদালতের এক আদেশে তাঁর বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
২০০৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে এবং ২০১৬ সালে ষষ্ঠ কাউন্সিলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তারেক রহমান। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে যুক্তরাজ্যে থেকেই দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এর পর বিভিন্ন মামলায় তারেক রহমানের সাজার রায় বাতিল এবং কোনো কোনো মামলায় আইনি প্রক্রিয়ায় অব্যাহতি পান। এর পর থেকে তাঁর দেশে ফেরার আলোচনা শুরু হয়।
চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারছেন খালেদা জিয়া
এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারছেন। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক স্থায়ী কমিটি সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, তিনি (খালেদা জিয়া) সিসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। তিনি সর্বোচ্চ চিকিৎসার মধ্যেই আছেন। আমরা খুবই আশাবাদী যে, তাঁর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যাবে। চিকিৎসকরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশেষ করে ডা. জোবাইদা রহমান সার্বক্ষণিকভাবে তদারকি করছেন।
একে