মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫

যেভাবে ভারতকে ছাপিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অংশীদার হয়ে উঠলো পাকিস্তান

মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৫
যেভাবে ভারতকে ছাপিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অংশীদার হয়ে উঠলো পাকিস্তান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্ক ২০২৫ সালের জানুয়ারির শুরুতে ছিল চরম শীতল অবস্থায়। ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে ইসলামাবাদ তখন তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ও আন্তর্জাতিক পরিসরে অনেকটাই একঘরে। ২০২২-২০২৩ সালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠা এবং সাম্প্রতিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও পাকিস্তানের অর্থনীতি তখনো বহিরাগত অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

ওয়াশিংটনে পাকিস্তানকে দেখা হতো অনির্ভরযোগ্য ও সীমিত কৌশলগত গুরুত্বসম্পন্ন দেশ হিসেবে। দেশটির শক্তিশালী নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনা করা হতো অস্বচ্ছ, দ্বিমুখী আচরণে অভ্যস্ত এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অনিচ্ছুক হিসেবে। বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছিলেন, পাকিস্তান এক দশকের মধ্যে কিংবা ১৯৯০-এর দশকের পর সবচেয়ে গুরুতর জাতীয় নিরাপত্তা সংকটে পড়তে পারে।

কিন্তু ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ দৃশ্যপট আমূল বদলে যায়। পাকিস্তান যেন এক ঝটকায় পরিত্যক্ত রাষ্ট্র থেকে অংশীদারে পরিণত হয়। খুব কম দেশই এত দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির পরিবর্তন দেখেছে। দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিবর্তনশীল পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে এখন পাকিস্তান।

কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকেও ট্রাম্পের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টারা শুরুতে পাকিস্তানকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। বিশেষ করে, চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাদের উদ্বেগ বাড়িয়েছিল। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ প্রায়ই বেইজিংয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ‘সমুদ্রের চেয়েও গভীর, পাহাড়ের চেয়েও উঁচু’ বলে বর্ণনা করে থাকে। ট্রাম্পের নতুন পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক মহলে তখন স্পষ্ট ধারণা ছিল যে ভারতের ওপর জোর দেওয়া হবে, ইন্দো-প্যাসিফিকে কোয়াড জোটকে শক্তিশালী করা হবে ও ভারতের দীর্ঘদিনের স্বার্থে ইসলামাবাদকে পাশে সরিয়ে রাখা হবে।

তবে ওয়াশিংটন যখন ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ অবস্থানে ঝুঁকছিল, তখনই ভারতের গতিপথ নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকে। দেশটির ক্রমবর্ধমান হিন্দুত্ববাদী অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, নাগরিক স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ, অসম সামরিক পারফরম্যান্স ও কূটনৈতিক অনমনীয়তার প্রবণতা- এসব বিষয় দীর্ঘদিন উপেক্ষিত থাকলেও ধীরে ধীরে ভারতকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার নির্ভরযোগ্য শক্তি হিসেবে দেখার প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।

পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় কয়েক দফা নীরব সন্ত্রাসবিরোধী যোগাযোগে, যা ইঙ্গিত দেয়- ইসলামাবাদ অবশেষে বাস্তব সহযোগিতায় আগ্রহী। মার্চ মাসে ট্রাম্প যখন এক জাতীয় ভাষণে হঠাৎ করেই পাকিস্তানের ভূমিকার প্রশংসা করেন, তখন ওয়াশিংটনে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ে। এই বক্তব্য বহুদিনের নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল এবং তথাকথিত ‘ডিসি ব্লব’ বুঝতে বাধ্য হয় যে পাকিস্তানকে ঘিরে নতুন বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে।

(‘ডিসি ব্লব’ বলতে সাধারণত ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক, একটি নির্দিষ্ট বৈদেশিক নীতি-নির্ধারণী চক্রকে বোঝানো হয়, যা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।)

ইসলামাবাদ এই সুযোগ দ্রুত কাজে লাগায়। পাকিস্তানের প্রতিটি ছোট সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ ওয়াশিংটনে অপ্রত্যাশিত প্রশংসা কুড়াতে থাকে, আর সেই প্রশংসাই আরও গভীর সম্পৃক্ততাকে উৎসাহিত করে। দীর্ঘদিনের ভঙ্গুর ও লেনদেননির্ভর সম্পর্ক ধীরে ধীরে নতুন গুরুত্ব পেতে শুরু করে।

যেসব ট্রাম্প কর্মকর্তা একসময় পাকিস্তানকে তুচ্ছ করতেন, তারাই এখন দেশটিকে সাড়া দেওয়া, কার্যকর ও নমনীয় অংশীদার হিসেবে বর্ণনা করছেন। এক ধরনের ইতিবাচক চক্র তৈরি হয়, আরও সহযোগিতা আসে, প্রশংসা বাড়ে, আর সম্পর্ক গভীর হয় এমন গতিতে, যা কয়েক মাস আগেও ওয়াশিংটনের কল্পনার বাইরে ছিল।

মে মাসে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের স্বল্পমেয়াদি কিন্তু তীব্র সংঘর্ষ এই পরিবর্তনের বড় মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পাকিস্তানের অপ্রত্যাশিত পারফরম্যান্স ট্রাম্পকে হতবাক করে দেয়। এই সংঘাতে পাকিস্তানের সামরিক শৃঙ্খলা, কৌশলগত মনোযোগ ও অসম সক্ষমতা এমনভাবে প্রকাশ পায়, যা ওয়াশিংটন আগে অসম্ভব মনে করত। যারা পাকিস্তানকে ক্ষয়িষ্ণু শক্তি হিসেবে ধরে নিয়েছিল, তারা আবার দেশটিকে গুরুতর আঞ্চলিক খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে।

এই অভিজ্ঞতা ট্রাম্পের চোখে কৌশলগত মানচিত্র নতুন করে আঁকে। পাকিস্তান এখন তার বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়া কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।

এই নতুন গুরুত্ব পাকিস্তানের সামরিক আধুনিকীকরণকেও গতি দেয়। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড কাঠামো পুনর্গঠিত হয় এবং ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ নামে নতুন শীর্ষ পদ সৃষ্টি করা হয়। এই পদে নিয়োগ পান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির, যিনি একই সঙ্গে সেনাপ্রধানের দায়িত্বও পালন করছেন।

এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, ভারতের উদাসীনতা ও পাকিস্তানের কৃতজ্ঞতা, যখন ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি আনতে মধ্যস্থতা করেন। যুদ্ধ শুরু নয়, যুদ্ধ শেষ করতে চান- এমন ভাবমূর্তি গড়া ট্রাম্পের কাছে ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল বেদনাদায়ক। আর এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের গুরুত্ব ওয়াশিংটনে দ্রুত বেড়ে যায়।

ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহলে নতুন তারকা হয়ে ওঠেন আসিম মুনির। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার সম্পর্ক এমন এক রসায়নে পৌঁছায়, যাকে উপদেষ্টারা আধা-রসিকতায় ‘ব্রোম্যান্স’ বলেও উল্লেখ করেন। ওয়াশিংটনের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় মুনিরকে দেখা হয় রহস্যময়, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং নিজ ভাবমূর্তি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণকারী একজন নেতারূপে। পাকিস্তানও এই মনোযোগ উপভোগ করে এবং ট্রাম্পকে তুষ্ট করতে নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে হালকা রসিকতাও করে, যা গণমাধ্যমে বাড়তি আলোচনার জন্ম দেয়।

এর পুরস্কার হিসেবে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ পান মুনির—পাকিস্তানের কোনো সামরিক প্রধানের জন্য ইতিহাসে এই প্রথম। ক্যামেরা এই দৃশ্য উপভোগ করে, ট্রাম্প তো আরও বেশি। প্রায় রাতারাতি পাকিস্তানকে ঘিরে সন্দেহ ও সতর্কতার জায়গা নেয় আগ্রহ ও উদযাপন। এর দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মুনির আবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন এবং সেন্ট্রাল কমান্ড সদরদপ্তরে লালগালিচা সংবর্ধনা পান। সেখানে তিনি বিদায়ী কমান্ডার জেনারেল মাইকেল কুরিলা এবং জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইনের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন।

২০২৬ সালের শুরুতে পাকিস্তান এখন ট্রাম্পের উদীয়মান বৃহৎ দক্ষিণ এশিয়া ও দূরপ্রাচ্য কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে। ইসলামাবাদ যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের সঙ্গে একটি নীরব ও বিশ্বাসযোগ্য যোগাযোগের পথ, গাজা উপত্যকার জটিল সমীকরণে সম্ভাব্য ভূমিকা এবং চীনের আঞ্চলিক প্রভাব মোকাবিলায় সূক্ষ্ম কিন্তু কার্যকর ভারসাম্যের মতো একাধিক কৌশলগত সুযোগ দিচ্ছে।

ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাতেই পাকিস্তান জড়িয়ে পড়েছে। বছরের শুরুতে যে সম্পর্ক ছিল প্রাথমিক ও দ্বিধাগ্রস্ত, তা এখন কৌশলগত কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে- যা ওয়াশিংটনের কল্পনাতেও ছিল না।

ওয়াশিংটনে ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ যুগ আপাতত শেষ হয়েছে, যদিও এটি স্থায়ী হবে কি না, তা নির্ভর করছে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপের ওপর। পাকিস্তানের এই রূপান্তর এখনো চলমান, এর চূড়ান্ত রূপ স্পষ্ট নয়। তবে এর ভূরাজনৈতিক প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চোখে পাকিস্তান নিজ যোগ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অর্জন করেছে ও দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্য নতুন করে লিখে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতেও মৌলিক পরিবর্তন আসছে।

সূত্র: ওয়াশিংটন টাইমস

এমআই


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল