শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

কার্ডিয়াক সার্জন প্রফেসর ডা. নাসির উদ্দিন আহমেদ (পর্ব-১)

শুক্রবার, জুলাই ৩০, ২০২১
কার্ডিয়াক সার্জন প্রফেসর ডা. নাসির উদ্দিন আহমেদ (পর্ব-১)

মঈনুদ্দিন মানু : 

দেশ ও আন্তর্জাতিক চিকিৎসা পরিমন্ডলের প্রতিথযশা একজন কার্ডিয়াক সার্জন প্রফেসর ডাক্তার নাসির উদ্দিন আহমেদ।

অনেকেই হয়তো তাঁর নাম শুনেছেন কিংবা শুনেননি। দেশে যখন হৃদরোগের চিকিৎসার ক্ষেত্র অনগ্রসরমান, অপ্রতুল ছিলো, মানুষ যখন প্রতিনিয়ত সুচিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী ভারত, সিংগাপুর, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেতো। ঠিক সেই সময়ে অর্থাৎ ১৯৮১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দেশের ইতিহাসে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের প্রথম ওপেন হার্টসার্জারির সফল অপারেশনে জাপানী টিমের সমন্বয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞ সিনিয়র ডাক্তার যথাক্রমে প্রফেসর ডাক্তার নবী আলম খান (প্রয়াত), প্রফেসর ডাক্তার এস. আর খান, প্রফেসর ডাক্তার মিনহাজ, প্রফেসর ডাক্তার ফজলে এলাহি, প্রফেসর ডাক্তার খলিলুর রহমান প্রমুখের সাথে একজন হার্ট সার্জেন্ট হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এই ডাক্তার নাসির উদ্দিন আহমেদ।

একজন কার্ডিয়াকসার্জেন হিসেবেও শুধু নয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রখরমেধাদীপ্ত প্রত্যয় আর দেশাত্মবোধে বলিয়ান হয়ে স্পর্ধিত বিশ্বাসে সেবার নেশায় সেই যে তাঁর চিকিৎসাজীবনের পথচলা শুরু তা এখন অভিজ্ঞতায়, মমত্ববোধে আরো গতিময় সুশৃঙ্খলিত উদ্যোগ আর উদ্যোমে আরও প্রাণসঞ্চারিত হয়ে আছে।

জীবনপরিচর্যায় জীবনবিলাসী জীবনেচ্ছু মানুষেরা নিরুপায় হয়ে বাইপাস কিংবা ওপেনহার্ট অপারেশেনের মাধ্যমে নতুন জীবন পেয়ে যেমন নিজেকে ঐশ্বর্যময় মনে করে ডাক্তার নাসির উদ্দিন আহমেদও চিকিৎসা পেশায় নিজেকে মানুষের জন্য উৎসর্গে দেবতুল্য হয়ে এখনো মানবসেবায় নিজেকে ঐশ্বর্যবান মনে করেন।

নবীন শিক্ষানবিশ হিসেবে ডাক্তার নাসির তাঁর ডাক্তারী জীবন শুরু করে পরিণত বয়সেও তারুণ্যদীপ্ত হয়ে পেশাকে ভালোবেসে আত্মস্থ অঙ্গীকারে দেশে এবং আন্তর্জাতিক চিকিৎসা পরিমন্ডলে নিজের ভিত্ কে শক্ত করে এবং আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে মেধা-মনোবলের সবটুকুকে কাজে লাগিয়ে এখনো সেই ধারাবাহিকতাকে অক্ষুণ্ন রেখেছেন।
আমি ভেতরের তাগিদ থেকে নির্মোহবোধে আত্মীয়তার পারিপার্শ্বিক বন্ধন ও ভালোবাসার ঋণ থেকে নয় কিংবা লেখক হিসেবেও নয়- একেবারে আত্মনিমগ্ন হয়েই ডাক্তার নাসিরের আশৈশব থেকে শুরু করে তাঁর ডাক্তার হওয়ার বর্ণাঢ্য জীবন পরিক্রমার কিছু খন্ডিত চিত্র তুলে ধরবার চেষ্টা করবো। দেশবাসীর প্রতি ডাক্তার নাসিরের দায়বদ্ধতা তাঁকে কতটা নিবিষ্ট করেছে, নিজে কতটা দিতে পেরেছেন অথবা কতটা পারেননি তাঁর উৎসবময় উৎসর্গের ব্যপ্তি তাঁর আনন্দ-বেদনায় তাঁর আত্মনিমগ্নতার হাসি-আনন্দ দুঃখ-বেদনা কিংবা সাফল্যের জয়গানে তিনি নিজেকে কিভাবে আত্মস্থ করেছেন কিংবা সংসার, সমাজে,রাষ্ট্রে কিংবা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তাঁর প্রাপ্তি প্রত্যাশা তাঁকে কতটুকুন দিয়েছে-তিনিই বা কতটুকুন পেয়েছেন তাই-ই অত্যন্ত লঘুভাবে বিধৃত করার প্রয়াসই আমার এই লেখার অনুপ্রেরণার উৎস।

নাসির উদ্দিন আহমেদ এর জন্ম কিংবা শৈশব-কৈশোরের জীবন শহরকেদ্রিক কোন অট্টালিকার বৈভববলয়ের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠেনি। গাছগাছালির ছায়াঘেরা সবুজ অরণ্য, মেঠোপথ, পাখপাখালির কিচিরমিচির শব্দ আর আবহমান বাংলার চিরঐতিহ্যের গাজিখালি-ধলেশ্বরীর পাড়ভাঙা পলিবিধৌত তীরঘেষা নয়নাভিরাম একসময়ের নিভৃত এক গ্রাম- কাংশা'তে তাঁর জন্ম। বেড়ে ওঠা বড়ো হওয়াও তাঁর এখানেই।
মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলায় অবস্থিত এই কাংশা গ্রাম।
বাবা আব্দুর রশিদ তখন রাজবাড়ী জেলার কালুখালি উপজেলার ভূমি অফিসের কর্মকর্তা।বাড়ির পাশের স্রোতস্বিনী ধলেশ্বরী নদী পার হয়ে সিঙ্গাইরের রাস্তায় ঘোড়ার গাড়িতে উঠিয়ে বাবা আব্দুর রশিদ ছোট্ট আদরের তুলতুলে মায়াবী চেহারার নাসিরকে একদিন নিয়ে চললেন মানিকগঞ্জের আরিচা ঘাটে।



উদ্দেশ্য নিজ কর্মস্হল রাজবাড়ী জেলার কালুখালি তার কর্মস্হল ছোট্ট নাসিরকে কোলে পিঠে করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো!!
মাঝে উম্মত্ত পদ্মায় স্টিমারে ওঠে পদ্মা পারি দিতে হবে!! এতো ছোটো বয়সে ভালোমন্দের কী বোঝে এই নাসির।হাত থেকে না ফসকানো বাবার আশ্রয়ই তাঁর জীবনের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা।
পদ্মাপার তখনকার দিনে এক বেপরোয়া এক দুঃসাহসিক অভিযানের নাম।

ছোট্ট বেলায় দেখেছি এই পদ্মা পাড় থেকে পশুখাদ্য সংগ্রহের জন্য কাইশ্যা সংগ্রহ করতো বড়ো বড়ো গৃহস্থঘরের কৃষকরা।
কাংশার পাশেই কুরুঙ্গী। ভিন্ন জেলা ভিন্ন উপজেলা কিংবা ভিন্ন গ্রাম হলেও অভিন্ন অদূরত্বের চৌহদ্দিতে আমাদের বসবাস।
আমার আশৈশবের জীবন স্মৃতি ধামরাই উপজেলার সুয়াপুর ইউনিয়নে অবস্হিত এই কুরুঙ্গী গ্রাম!!

আমাদের ছিলো বিশাল এক নৌকা । বর্ষায় হাট-বাজারের কাজ ছাড়াও গৃহস্হলি সকল কাজ এই নৌকা দিয়েই সম্পন্ন করা হতো।

পাট কেটে জাগ দেয়ার পর পাট পচে গেলে সেগুলোও এই নৌকায় করেই বাড়িতে এনে শুকানো হতো।ধান কেটেও রাশি রাশি ধান নৌকায় ভরে বাড়িতে আনা হতো।

এ ছাড়া এই নৌকায় করেই আমার বাবা'র নেতৃত্বে বাড়ির রাখাল- মাঝি- মাল্লা নিয়ে এলাকার অনেকের মতো প্রায় প্রতিবছরই দিন দশেকের জন্য পশুখাদ্য সংগ্রহে প্রয়োজন মতো খাদ্যসামগ্রির মজুদ নিয়ে নৌকায় পরিভ্রমণে বের হতো পদ্মাপাড়ে কাইশ্যা সংগ্রহে।

প্রকৃতির ঋতু বৈচিত্র্যে পদ্মাচরে প্রাকৃতিকভাবেই বাতাসে বীজ ছড়িয়ে জন্ম নেয় মাইলের পর মাইল এই সুদৃশ্যমান কাইশ্যা।এগুলো যেমন প্রমত্ত নদী তীরের ভাঙন রক্ষা করে তেমনি মাটি ক্ষয়রোধসহ চরের মানুষের জীবন যাত্রাকেও করে সুসংহত ও নিরাপদ। ঘরের চালা,জ্বালানি কিংবা গো-খাদ্য হিসেবেও কাইশ্যা ব্যবহৃত হতো। মূলতঃ গো-খাদ্যের জন্যই এতদঅঞ্চলের গৃহস্থ ঘরের মানুষদের বর্ষা মৌসুমেই যেতে হতো এই কাইশ্যা সংগ্রহে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এই পদ্মায়।

ভাগ্য ভালো হলে উথালপাতাল ঢেউকে জয় করে সবাই নির্বিঘ্নে ঘাস (কাঁশবন সদৃশ'কাইশ্যা') নিয়ে ফিরে আসতো ঘরে। আমরা ছোটরা কাইশ্যা ভর্তি নৌকা বাড়ির ওঠোনে এলে আপনজনদের কাছে পেয়ে আনন্দে উৎসবে মেতে ওঠতাম। নৌকা বাঁধা ঘাটেই এই ঘাসগুলো মজুদ করে রাখা হতো। কাইশ্যাগুলোর গোড়ার দিকটা ছিলো আখরসের অনুকৃতি। আমরা এই কাইশ্যার উপর বসে আখের মতো এগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে রস টেনে নিতাম। আখরসের আস্বাদনে কখনো কখনো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতাম। বড়ো প্রাপ্তির বড়ো আনন্দ সে সময় না জেনে না বুঝেই এটাতেই আত্মস্থ হয়ে দিনমান বিভোর থাকতাম- যা এখনো আমায় উদ্বেলিত করে- বহুদূরে ফেলে আসা স্মৃতিকে করে আলোড়িত ।
আর মনের কোনে বার বারে ভেসে ভেসে বেড়ায় অকথনের কত স্মৃতি কত কথন!!
আরিচা ঘাটে শিশু নাসির। নানা উচ্ছ্বাস আর ব্যাকুলতায় ভরা তাঁর শিশু মন।কখন পৌঁছবে সে কালুখালি! মনের মধ্যে নেই তাঁর কোন দুঃস্বপ্ন কিংবা দুর্ঘটনাকবলিত হওয়ার কোন বোধ। আছে শুধু পদ্মাপাড়ের রোমাঞ্চকর হাতছানি! পাহাড়সমান ঢেউ কিংবা অশনি কোন সংকেতও তাঁর মনকে আচ্ছন্ন করেনি। দৃশ্যপটে ভাসছে শুধু স্টিমার আর পদ্মার অথৈজলের ঢেউ !
নাসিরের শিশুমন উদ্বেল আর বেপরোয়া আনন্দে দোল খেতে লাগলো। গতরাতে তন্দ্রা কিংবা স্বপ্নে স্টিমারের দোল খাওয়ার স্বপ্নময়তা তাঁকে ঘিরেও ধরেছিলো। সময় যত এগিয়ে এলো স্টিমার ভাবনায় সে তন্ময়ে ততো বেশি আবিষ্ট হলো।

স্টিমার ঘাটে ভিড়বার আগেই সে এরই মধ্যে সুযোগে পদ্মার অথৈজলে বাবা আব্দুর রশিদের হাতের উপর স্নান সেরে নিলো।
প্রমত্ত পদ্মায় গা ভেজানো এ গোসল নাসিরের কাছে জীবন স্মৃতির এক অমোঘ আনন্দ হয়ে এখনো তাঁকে তাড়া করে যখন-তখন।

পদ্মার অথৈ জলের ঢেউ-এ গোধূলির লাল আভা যখন জলকেলি খেলছিলো আনন্দবন্যার মধ্যেই তখনই গোয়ালন্দ হয়ে স্বপ্নের স্টিমার অবশেষে তাদেরকে পৌঁছে দিলো বাবার কর্মস্হল রাজবাড়ীর কালুখালির ডাকবাংলোয়।

বাবার অফিসের একজন এসে তাঁকে কাঁধে নিয়ে ঢুকলো অফিস সংলগ্ন ডাক বাংলোয়।অল্প ক'দিনের কালুখালি অবস্হান এখনো তাঁর অন্তর জুড়ে- তাঁকে স্বপ্নময় করে- স্মৃতিকাতরে বিভোর করে বারবার প্রতিবার!!

নিভৃত নিরবে কালুখালি এখনো তাঁকে ডাকে
কিন্তু কী অদৃশ্য বন্ধন যেন তাঁকে আটকে
দেয় তাঁর পথ!!

দেড়-দু'বছর থেকে শুরু করে পরিণত জীবনের বিরল স্মৃতিগুলো অকপটে আর দৃঢ়মেধাশক্তির প্রাবল্যে হাজারো ব্যস্ততাকে সামলে নিয়েই ডাক্তার নাসির আমাকে বলতে থাকে তাঁর না বলা অতীত কথাগুলো। আর আমিও মুগ্ধতার জাল বিছিয়ে তন্ময় হয়ে শুনতে থাকি দেশের শীর্ষস্হানীয় দীর্ঘ অভিজ্ঞ ব্যস্ত একজন কার্ডিওভাসকুলার থোরাসিক সার্জারী বিশেষজ্ঞের
জীবনকাহিনি - যার অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে রয়েছে

সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সফলভাবে সমাপ্ত করা দশ হাজারেরও বেশি ওপেন হার্ট সার্জারীসহ ক্লোজড হার্ট অপারেশনের ঐশ্বর্যময় ইতিহাস !!!

(চলবে)

লেখক :

ডেপুটি ন্যাশনাল কমিশনার, মিডিয়া এন্ড পাবলিকেশন্স, বাংলাদেশ স্কাউটস। 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল