শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

জেসিমিন আরা বেগমের গল্প

বাঁশবুনিয়া গ্রাম থেকে পটুয়াখালী শহর (সাত)

শনিবার, অক্টোবর ১৬, ২০২১
বাঁশবুনিয়া গ্রাম থেকে পটুয়াখালী শহর (সাত)

.....................

যমজ কইন্যার জন্ম 
কথায় বলে মাঘের শীত বাঘের গায়। এবার মাঘ মাসে যেন শীত আরো একটু জাঁকিয়ে বসেছে। ধান কাটা, মাড়াই, সিদ্ধ আর শুকানোর কাজ শেষ। কিছু ধান মাড়াই করেই হাটে নিয়ে বিক্রি করা হয়েছে। বাকি ধান ঢেঁকিতে ছাটাই করে চাল করে গোলায় ভরা হচ্ছে। ধান কাটা শেষে কিছু জমিতে কলাই চাষ করা হয়েছে, কলাইয়ের সবুজ সতেজ ডগাগুলো নাড়া বেয়ে লকলকিয়ে উঠছে। 
মাত্র দুই মাস আগে হালিম মারা গেছে, তার স্মৃতি সবার মনেই তুষের আগুণের মত ধিকি ধিকি জ্বলছে। কিন্তু সাবই ভুলে থাকতে চেষ্টা করছে। মায়ের শোকটা যেন একটু বেশি। এই যে পৌষ মাসে এতো পিঠা খাওয়া হল, একটু পিঠা মায়ের গলা দিয়ে নামল না। আহারে ছোট ছেলেটা পিঠা খেতে বড় ভালোবাসত! 
মেহের নেগার শরীর এতো ভারি আর খারাপ লাগে যে চলতে ফিরতেই কষ্ট হয়। তাও সংসারের কাজ তো করতেই হয়। আজ কয়েকটা বড়া (তেলের পিঠা) পিঠা বানাচ্ছে। পিঠা ভেজে একটা থালায় করে ডান হাতে মিনারের দিকে এগিয়ে দেয় আর বাম হাতে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। পেটের বাচ্চাটা খুব জোরে নড়াচড়া করছে, সে কি মায়ের কষ্ট বুঝতে পারছে?  
আজ সোমবার, সকাল থেকেই ঘন কুয়াশায় চারিদিক ঢাকা। একটু বেলা হয়তে সূর্য যেন আলসে মেয়ের মত আড়মোড়া ভেঙ্গে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। মেহের নেগা ঢেঁকি ভানার মহিলাদের বলল, 'আমার শরীর ভালো লাগতেছে না। আইজ আর ধান ভানার দরকার নাই'। তারা একটু বসে পান খায়, আর গল্প করে। একজন বলে মেরধার ঝি, তোমার পেটটা উপরের দিকে বেশি উঁচা, এবারো তোমার পোলা অইবে দেইখো। আল্লায় তোমার এক পোলা নিছে, হেই পোলারেই আবার ফিরাইয়া দেবে'। মেহের নেগা চুপ করে থাকে, এসব আলোচনা আর ভালো লাগে না। ছেলে মেয়ে যাই হোক হয়ে গেলেই বাঁচা যায়। বসে থাকতে থাকতেই তীব্র ব্যথায় উহ করে ওঠে মেহের নেগা। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত মহিলারা বুঝতে পারে যে ওর প্রসব বেদনা উঠেছে।  খবর দেয়া হয় দাইকে, দুইজন অভিজ্ঞ দাই চলে আসে। ইতোমধ্যে মাষ্টার গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে বদলি হয়ে এসেছে। 
প্রসব বেদনা নাকি পৃথিবীর সব চেয়ে কষ্টকর বেদনা। কয়েক ঘণ্টা ধরে প্রচণ্ড ব্যথার কষ্ট আর যমে মানুষে টানাটানির মধ্য দিয়ে একটি কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো। দাইয়েরা হাফ ছেড়ে বাঁচল। একজন বাঁশের কঞ্চি দিয়ে নাড়ি কেটে নবজাতক শিশুটিকে পুরানো নরম কাপড় দিয়ে মুছে দিচ্ছিল। ঠিক তখন অন্য দাই চিৎকার করে উঠল, 'ও মোর আল্লা, প্যাডে দেহি আর একটা বাচ্চা লড়তে আছে'। প্রথম দাই চমকে তাকিয়ে দেখে ঘটনা সত্যি। দাই বাচ্চা কোলে নিয়ে বাইরে এসে বাচ্চাকে তার বড় বোনের কোলে দিয়ে বলল, 'তোমার বুইনেরে নেও, তোমার মায়ের প্যাডে আর একটা বাচ্চা আছে'। দাই দ্রুত চলে গেলো। কিন্তু অনেক সময় চলে গেলো দ্বিতীয় বাচ্চা আর হচ্ছে না, রোগিণী নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। দাই মাস্টারের কাছে এসে বলল, 'বাবা, তোমার বউর অবস্থা বেগতিক। তড়াতড়ি কবিরাজেরে খবর দেও'। বাড়ির মেজো ছেলে নবম শ্রেণীর ছাত্র, এক দৌড়ে গিয়ে কবিরাজকে তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এলো। কবিরাজ এসে একটা ইঞ্জেকশন দিলো। এর কিছুক্ষণ পরে আর একটি মেয়ের জন্ম হলো। মাস্টারের এতদিন ছিল তিন মেয়ে, এখন হলো পাঁচ মেয়ে। একসঙ্গে দুই কন্যার জন্ম হওয়াতে কেউ খুশি না হলেও, এরা দুইজন মিলে মাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রে যে সফল হয়নি তাতেই  সবাই খুশি।  
গ্রামে আর কারো ঘরে যমজ বাচ্চা নেই, তাই যমজ বাচ্চা দেখতে লোকজন এসে ভিড় করে। সবাই বলে,  'দেখতে তো একই রকম, তোমরা চিনবা কেমনে'? । বড় বোন বলে, 'ভালো করে দেখেন এর কপালটা একটু বেশি উঁচু না? এ বড়, আর ও ছোট'।
- নাম কি থুইছ?
- বড় জনের নাম রিনা, আর ছোট জনের নাম বিনা। 
- এতো ছোডো নাম, এগুলা আবার কেমন নাম?
- আমরা বই পরে নাম রাখছি চাচি।  
- অ, তয় তো ভালোই নাম অইবে। 
পান খেয়ে লোকজন বিদায় হয়। 
বড় দুইবোন ছোট দুই বোনের জন্য ছোট ছোট জামা বানায়, ঠিক যেন পুতুলের সাইজের। দুজন শুধু ঘুমায়, খিদা লাগলে একটু নড়াচড়া করে আর দুর্বল কণ্ঠে কাঁদে। ছোটজন মনে হয় বেশি দুর্বল। এর মধ্য বড় বোন খেয়াল করে ছোটজন কেমন যেন মাঝে মাঝে নীল হয়ে যায়, মনে হয় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এভাবে সাদা ফর্সা, হালকা লালচে আর নীল রং ধারণ করতে করতে শুক্রবারে মানে জন্মের পাঁচদিন পরে ছোটবোন বিনা মারা গেলো। ধারনা করা হয় জন্মের সময়ের কষ্ট বা ইঞ্জেকশনের সাইড এফেক্টে সে মারা গেছে।  
মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে একই পরিবারের দুইটি শিশুর মৃত্যু হল।          
মাকে প্রায় মেরে ফেলতে চাওয়া বেঁচে থাকা শিশুটি আমি। আমার নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়,  নিশ্চয়ই আমি গায়ের জোরে বিনাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজে আগে চলে এসেছি। অথবা আমার বোন ভদ্রতা করে আমাকে আগে আসতে দিয়েছে। এমনো তো হতে পারে আমরা দুজনে টস করেছিলাম এবং আমি টসে জিতে গেছি। 
সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন কার জন্য কোনটা ভালো ছিল।  যেমন সক্রেটিস মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, "I to die, and you to live. Which is better God only knows."

লেখক পরিচিতি :

জেসমিন আরা বেগম, 
কেমিকৌশলী, ১৩ তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য এবং বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। 
প্রাক্তন উপ-পরিচালক,  বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, (বিপিএটিসি)।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল