শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

অন্যরকম এক পুলিশের গল্প

মঙ্গলবার, নভেম্বর ৮, ২০২২
অন্যরকম এক পুলিশের গল্প

অরণ্য সৌরভ:

বান্দরবানের মুসলিম পাড়ার এক মহিলা। নাম তার বুলু বেগম, স্বামী দূরারোগ্যে আক্রান্ত। তাকে জিজ্ঞেস করলেন কোন কাজ পারেন? সে বলল, না। তবে মাঠে কৃষি কাজ করতে পারব। যেই কথা সেই কাজ। অল্প পরিমাণ জমি বর্গা নিয়ে বীজ ও সার দিলেন নারীকে। পরে দেখা গেল, তিন হাজার দুইশ টাকার পুঁজিতে সে নারী প্রথমবারেই প্রায় ৪৫ হাজার টাকার শাকসবজি বিক্রী করলেন। স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজে পেলেন বুলু বেগম।
বালাঘাটা বাজারে দুটি ছোট সন্তান নিয়ে ভিক্ষা করছিলেন নাজমা বেগম। জানা গেল, স্বামী ক্যানসারে আক্রান্ত ও মা প্যারালাইজড হয়ে শুয়ে আছেন ঘরে। ট্রাফিক মোড়ে একটি ছোট মুদি দোকান দিয়ে সে নারীকে বসিয়ে দিলেন তিনি। দোকানের নাম রাখলেন ‘মানবিক ষ্টোর’। অক্লান্ত পরিশ্রম আর চেষ্টার ফলে সে নারী এখন সবজি ও ফলের আরো দুটি দোকান দিয়েছেন। এমনই অনেক গল্পের পেছনের নায়ক এক পুলিশ সদস্য।

এখন পর্যন্ত বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও লক্ষীপুরে প্রায় ৪৮৭ জনকে বিভিন্নভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। এছাড়া ৩৪ জন শারীরিক প্রতিবন্ধীকে হুইল চেয়ার ও কর্ম উপযোগীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। বান্দরবান ও চট্টগ্রামে ২২ জন বয়স্ক অসহায় পরিবার পরিজনহীন প্রবীনকে চিকিৎসার খরচ বহন করছেন। ৪ জন পঙ্গু লোককে কিনে দিয়েছেন অটোরিকশা। চট্টগ্রামের মালিপাড়ায় ২ জন বয়স্ক বৃদ্ধবৃদ্ধাকে বসবাসের ঘর তেরি করে দিয়েছেন।
জনতার বন্ধু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেও, অনেকেই পুলিশের দিকে নেতিবাচক চোখে তাকায়। তবে নেতিবাচকতার সীমানা পেরিয়েছেন একজন পুলিশ সদস্য। তিনি কনস্টেবল মেহেদি হাসান দোলন।  ডিউটির পর কখনো ছুটে যান অসহায়ের কাছে, কখনোবা শীতার্তের কাছে উষ্ণতার চাদর নিয়ে, আবার কখনোবা কারো বেকারত্বের দুঃখ ঘুচাতে স্থায়ী বা ভ্রাম্যমাণ কোনো ব্যবসার ব্যবস্থা করতে। কখনো কখনো কৃষকের কাছে হাজির হন কৃষি সরঞ্জাম নিয়ে। আবার হুট করেই দেখা গেল বই হাতে অ আ ক খ পড়াচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিতের জন্য গড়া পাঠশালায়। এতোসব নিজের ভালোলাগা ও মানুষের তরে কিছু করার প্রত্যয়ে করে যাচ্ছেন নিজ উদ্যোগে। মানবিক কাজের পুরস্কার হিসেবে প্রশংশিত তিনি একজন মানবিক পুলিশ হিসেবেও সমধিক পরিচিত।

মানবিকতার স্বপ্ন আর দূরন্তপনায় কেটেছে দোলনের ছেলেবেলা। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের ব্যবসায়ী ফারুক ও গৃহিণী নিলুফার ইয়াছমিন দম্পতির একমাত্র ছেলে মেহেদী হাসান দোলন। মানুষের সেবা করা যায় এমন চাকরী করার স্বপ্ন নিয়ে ২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন।

মেহেদি হাসান দোলন বলেন, ‘এ পৃথিবীতে শুধু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য চাকুরী নয়। চাকুরীর পাশাপাশি মানুষ, দেশ ও পৃথিবীর তরেও কিছু করার রয়েছে। কাজে বের হলে সাধারণ মানুষ এখন ‘পুলিশ দোলন ভাই’ এমন অভিধায় ডেকে থাকেন।’ সম্প্রীতি-সহমর্মিতা ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হবে জনতা ও পুলিশ। সেই সাথে তার মানবিক কাজগুলো পুলিশ ও জনতার ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টিতে অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেও তিনি মনে করেন।


মানবিক পরিবেশ 

স্যোসাল মিডিয়ায় পরিবেশ বিষয়ক বিভিন্ন ভিডিওতে পরিবেশ ধ্বংস ও দূষণের ব্যপ্তি দেখে পরিবেশ ও নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নেন। বৃক্ষরোপণের এ উদ্যোগের নাম দিয়েছেন মানবিক পরিবেশ। বিগত ৬ বছরে বান্দরবান, চট্টগ্রাম, লক্ষীপুরে প্রায় ২৬ হাজারের বেশি বৃক্ষরোপণ করেছেন তিনি। সবচেয়ে বেশি বৃক্ষরোপণকৃত এলাকা বান্দরবান। সমাজের অবহেলিত মানুষের সেবার পাশাপাশি পরিবেশের দিকেও নজর দিয়েছেন এই পুলিশ সদস্য। 'পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী জমা দিন, পরিবেশ বন্ধু গাছ নিন।' পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর- এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ঔষধি, বনজ ও ফলদ গাছের চারা বিতরণ করেন তিনি।

মানবিক পাঠশালা

বান্দরবনের পাহাড়ি দুর্গম অঞ্চলে অনেক পরিবারের শিশুরা শিক্ষা বিমুখ। অনেক পরিবার নিজেরাই ছেলেমেয়েদেরকে পড়াতে চান না। কারণ খাতা-কলম কেনার সার্মথ্য নেই। সে সব শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে শুরু করলেন তার শিক্ষা কার্যক্রম। শিশুদেরকে শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়ে আসার মতো অর্থ জোগাড়ের প্রেক্ষিতে দোলন বলেন, ‘২০০ টাকায় ৪০টি কলম পাওয়া যায়। ৩০০ টাকায় ২ রিম কাগজে প্রায় ৩০টির বেশি খাতা বানানো যায়। এভাবেই ছোট ছোট করে পৌঁছে দিচ্ছি শিক্ষা উপকরণ।’ দোলনের এমন কার্যক্রমে অভিভাবকদের ভালোবাসা, উৎসাহ এবং ছেলেমেয়েদের প্রবল আগ্রহের ফলে গড়ে তুলেছেন একটি ছোট স্কুল। নাম রেখেছেন ‘মানবিক পাঠশালা’। ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে বান্দরবানে প্রথম ‘মানবিক পাঠশালা’য় ৬৪ জন শিক্ষার্থী এবং চট্টগ্রামের ঝাউতলায় দ্বিতীয় ‘মানবিক পাঠশালা-২’ ৪৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা সামগ্রীর পাশাপাশি ইউনিফর্ম, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে সাবান, হ্যান্ডওয়াশ, ব্রাশ, টুথপেস্ট, নেইল কাটার, ডিটারজেন্ট পাউডার, তোয়ালে বিতরণ করেন।

মানবিক কৃষি

পাহাড়ি জনপদে কৃষিকাজের জন্য টাকা দিয়ে জমি বর্গা নিতে হয়। এমন কয়েকজনকে টাকা দিয়ে বর্গা জমি চাষের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। অর্ধশত মানুষকে চাষের জন্য সার, বীজ, কীটনাশক, ঔষধ ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

অর্থের জোগান নিয়ে দোলন বলেন, ‘বেতনের টাকা থেকে প্রতিমাসে ৬ হাজার টাকা মানবিক কাজের জন্য রাখি। মানবিক কাজ করতে গিয়ে খালি পকেটে কিভাবে মাসের পর মাস কাটাতে হয় সেটা এখন আমার স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।’

জন্মস্থান লক্ষ্মীপুর থেকে সামাজিক ও মানবিক কাজ শুরু করা দোলন বিগত ছয় বছরের বেশি সময় ধরে বান্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় মানবের তরে কাজ করে যাচ্ছেন।

তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন্সে কর্মরত। বান্দরবানের লেমুঝিড়ি, ভরাখালী, মুসলিম পাড়া, চড়–ই পাড়া, মিনঝিড়ি পাড়া, বাকিছড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় সামাজিক ও মানবিক কাজগুলো করেছেন বিগত ৫ বছর। এছাড়া নিজ এলাকায় একটি ফাউন্ডেশন গঠন করেছেন। যার মাধ্যমে প্রতিবন্ধিদেরকে হুইল চেয়ার, কৃত্রিম পা লাগানোসহ বেওয়ারিশ এবং ভুমিহীনদের কবর দেওয়ার জন্য গণকবরের ব্যবস্থা করেছে।
মানবিক পুলিশ দোলনের স্বপ্ন আমৃত্যু অসহায় মানুষের বন্ধু হয়ে পাশে থাকার এবং তাদেরকে সাহায্যের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে দুঃখ দূর করা। অসহায়, দরিদ্র মানুষের হাসিমুখেই খুঁজে বেড়ান তার জীবনের সুখ।

এমআই


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল