বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

ভালবাসার টানে সাড়া দেয় মৃত্যু

রোববার, মে ২, ২০২১
ভালবাসার টানে সাড়া দেয় মৃত্যু

ডাঃ জোবায়ের আহমেদ :
হাজী কামাল উদ্দিনের বয়স ৮০ পেরিয়েছে।

নিজে হাইপারটেনশান ও অস্টিও-আর্থাইটিসে ভুগছেন।

তিনি গত ছয় বছর ধরে আমার কাছে আসেন উনার স্ত্রী রাবেয়া খাতুনকে নিয়ে।রাবেয়া খাতুনের অনেক রোগ।

ডায়াবেটিস, এ্যাজমা,অস্টিওপরোসিস, ডিপ্রেশন ও রিকারেন্ট ইউটিআই।

কিছু রুগীর কাছে আমি শুধু তাদের চিকিৎসক থাকিনা,সন্তান হয়ে উঠি।

এটা আমার পরম ভাগ্য।

রাবেয়া বেগম আমাকে কোনদিন আব্বা ছাড়া কথা বলেননি।

একবার রাবেয়া বেগম একিউট সিভিয়ার এ্যাজমা নিয়ে আসলেন।কিছু রুগীর পাশে আমি তাদের ইমারজেন্সি সিচুয়েশন ওভারকাম না হওয়া অব্দি বসে থাকি।

রাবেয়া বেগম আরাম বোধ করায় আমি আমার রুমে চলে আসি।

রাত গভীর।অনুমানিক তিনটা বাজে।

আমি সেদিন রাতে জেগে ছিলাম,পড়ছিলাম নরওয়েজিয়ান উড,হারুকি মুরাকামির লেখা বিখ্যাত উপন্যাস।

হারুমি মুরাকামির বিখ্যাত একটা কথা আছে যা আমি কখনো ভুলিনা।
"Pain is inevitable
Suffering is optional"

তো বই বন্ধ করে ঘুমাবো এমন সময়ে ভাবলাম যাই আরেকবার রাবেয়া বেগমকে দেখে আসি।

ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি রাবেয়া বেগম বসে আছেন চোখ বুজে।হাজী সাহেব চিরুনি দিয়ে রাবেয়া বেগমের চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন।

আমি পেছন থেকে দেখে যাচ্ছি এই অপূর্ব দৃশ্য।

ভালবাসা পবিত্র, তার জ্যোতিতে উজ্জ্বল হাজী সাহেবের মুখ।

আমি কাছে গেলাম।

আমাকে দেখে হাজী সাহেব লজ্জা পেলেন।

আমি পিঠে হাত দিয়ে বললাম,চাচা আপনি চাচীকে এত ভালোবাসেন দেখে আমার চোখ ভিজে গেলো।

"বৃদ্ধ স্বামী স্ত্রী কে জড়িয়ে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই নারী ছাড়া আমার কেউ নেই,আমি ছাড়া তারও কেউ নাই।তার কষ্ট আমি সইতে পারিনা।"

তারপর বিষাদের ঝাঁপি খুলে দিলেন হাজী সাহেব।

৪ ছেলে এক মেয়ে উনাদের।সব সম্পদ ছেলেদের দিয়ে দিয়েছেন।

সম্পদ যখন হাতে ছিলো তখন ছেলে ও তাদের বউদের তোয়াজ ছিলো। এখন কেউ দেখার নেই।

মেয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে এসে মা বাবার সেবা করে।

আমি নিজেও খেয়াল করেছি এই দুইজন মানুষের সাথে মেয়ে ছাড়া আর কেউ কখনো আসেনি।

বৃদ্ধ বয়সে অবহেলিত জীবনের গল্প শুনে আমার চোখ ভিজে উঠলো।

পরের দিন দুই ছেলের বউ আসলো শ্বাশুড়িকে দেখতে।

আমি চেম্বারে ডাকলাম।আমি বললাম, ছেলের বউদের উনাদের যত্ন নিতে।

বললাম, আমার দাদা বলে গেছেন মানুষ তার মূলে ফিরে আসে।

আজ আমি যা আচরণ করবো,তাই আমার জন্য তোলা থাকবে।

যদিও আমার এখতিয়ারের বাইরে কিন্ত আমি কিছু রুগীর উপর অধিকার খাটাতে পারি।

আমি এটাও বলেছি, আজ আপনার বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ীকে অবহেলা করছেন, আগামীকাল তো আপনারা শ্বশুর শাশুড়ী হবেন, তখন যদি আপনার ছেলের বউ এমন আচরণ করেন,মানতে পারবেন??

যেহেতু হাজী সাহেবের চার ছেলেই বিদেশ থাকে, আপনাদের কি উচিত নয় এই দুইজন বৃদ্ধকে আগলে রাখা।

কখনো তো আপনাদের উনাদের চিকিৎসার জন্য উনাদের সাথে আসতে দেখিনি।

দুই বউ আগুন গরম হয়ে গেলো।

আমাকে কিছু না বলে চলে গেলো।

তারপর গিয়ে ধরলো হাজী সাহেবকে।

ডাক্তারের কাছে এসব কথা বলে হাজী সাহেব তাদের অপমান করেছেন।

হাজী সাহেবের আক্কেল হবে কবে এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো এক বউ।।
হাজী সাহেব আসলেন, আমার চেম্বারে।

চোখ গুলো অশ্রুসিক্ত।

আমি তাকিয়ে আছি,দাঁড়ি ভিজে অশ্রুর একটা ফোঁটা ফ্লোরে পড়লো।

রাবেয়া বেগম সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলেন।

আমাদের বকেয়া টাকা ছিলো। এক মাস পর ফোন দিলাম।

তখন হাজী সাহেব, ফোন ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন।

বললেন, আপনার মা আর নাই।।উনি আমাকে একা করে চলে গেছেন।

আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম।

তারও ১৫ দিন পর হাজী সাহেব আসলেন।

আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আপনার মা চলে গেছেন। আমার আর পিছুটান নেই।

আমারও সময় নিকটবর্তী।

এতগুলো বছর আপনার কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়েছি, আমরা কষ্ট দিলে ক্ষমা করে দিবেন বলে আমার হাত চেপে ধরলেন।

আমি হাজী সাহেবকে বুকে জড়িয়ে রাখলাম কিছুক্ষণ।

তারপর বিদায় নিলেন হাজী সাহেব।

যাবার আগে আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে গেলেন।

পরদিন দুপুরে খুব ব্যস্ত আমি চেম্বারে।

একটা নাম্বার থেকে বারবার কল আসছে। আমি রিসিভ করলাম।

ওপাশ থেকে এক মধ্যবয়সী রমনী কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন, আমার বাবা আপনার সাথে দেখা করে এসে আছর পড়লেন।

তারপর আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। রাতেই দাফন হয়ে গেছে।
আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। হাত কাঁপছিলো।

হাজী সাহেব অনেকবার আবদার করেছিলেন, উনাদের বাড়ি যেতে।

রাবেয়া বেগমের ইন্তেকালের পর উনাকে কথা দিয়েছিলাম সেদিন, যাবো আমি মায়ের কবর জিয়ারত করতে।
আফসোস সেই সময় আমি পেলাম না।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল