শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

উপজেলার গল্পগাথা : বিক্ষিপ্ত মনের লেখালেখি

মঙ্গলবার, মে ৪, ২০২১
উপজেলার গল্পগাথা : বিক্ষিপ্ত মনের লেখালেখি

ডা. অনিক ইকবাল :

গত কয়েকদিন ধরে ভোরের দিকে একটা শক্ত ঝড় হচ্ছে। প্রায়দিনই ডরমিটরি থেকে হস্পিটালে যাওয়ার রাস্তাটা ছোটখাটো ডালপালা, পাতা আর আবর্জনাতে ভরে থাকে। আশেপাশের গাছগুলোর দিকে তাকালে হস্পিটালের সদ্য প্রসূতি মায়েদের কথা মনে পড়ে যায়। দীর্ঘ ক্লান্তিকর একটা যুদ্ধের শেষে যেন কোনমতে একটু বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে! মাঝেমধ্যে হাঁটাপথে পাতার নিচে পরে থাকা দুয়েকটা মৃত পাখির বাচ্চার উপর পা পড়ে যায়। বিশ্রী শব্দটা কান পর্যন্ত না গেলেও তার অনুভূতিটা অটো রেকর্ডেড সাউন্ডের মত মাথার ভেতর ঘুরতেই থাকে। ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে বমি আসে। দিনটাই কেমন যেন অশুভ হয়ে যায়।

এদিকে এখন ধান কাটার মরসুম চলছে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। প্রায়দিনই দুপুরের বেশ আগে আউটডোরের কাজকর্ম শেষ হয়ে যায়। রোগী দেখা শেষ করে দরজাটা একটু ভেজিয়ে দিয়ে একটা বই খুলে বসেছিলাম। ইতস্তত ভঙ্গিতে দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিলো হিলি। হিলি আমাদের হস্পিটালের নাইটগার্ড। মাঝারি উচ্চতার এই মানুষটা সবসময় অস্বাভাবিকভাবে মাথা নিচু করে হাঁটে। হস্পিটাল কম্পাউন্ডের একটা ভাঙা কোয়ার্টারে একা একা থাকে। মানুষের সাথে কথাবার্তা তেমন বলে না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে কারো সাথে কথা বলতে হলে সেই নিচু মাথা আরো নিচু হয়ে যায়। হিলির এই অস্বাভাবিক স্বভাবের কারণে গত দুই বছরের বেশী সময় এই হস্পিটাল ক্যাম্পাসে থাকা সত্বেও আমি তার চোখ তো দূরের কথা মুখটাও কখনো পুরোপুরি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। 

আমি বললাম, "হিলি ভেতরে আসো।" 

ভেতরে ঢুকে বেশ জড়সড় হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে একটা কোণায় হিলি দাঁড়িয়ে রইলো। 

আমি বললাম, "বস। আমাকে কিছু বলতে চাও?" 

একটা টুল টেনে নিয়ে বসে হিলি আগের মতই মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কোন কথা বললো না। আমার জন্য বেশ অস্বস্তিকর একটা সিচুয়েশন। কি করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অন্যমনস্ক হয়ে বইয়ের পাতা উল্টাতে শুরু করলাম। এরকম শব্দহীন নিরবতা রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উপভোগ্য। হিলির সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় এর বিপরীত। সত্যি কথা বলতে তার সাথে আমার কোন সম্পর্কই নেই। রাতে রোগী দেখতে যাওয়া আসার পথে হস্পিটাল চত্বরের বাঁধানো বকুল গাছটার তলায় ওকে বসে থাকতে দেখি। কোনদিন কথা হয়েছে বলেও মনে পড়ে না। তাছাড়া এরকম অদ্ভুত স্বভাবের কারণে হস্পিটালের অধিকাংশ স্টাফ হিলিকে এড়িয়ে চলে। 

আমি বইটা বন্ধ করে বললাম, "হিলি তুমি যদি কিছু বলতে চাও তাড়াতাড়ি বল। আমি রুমে যাবো।" 

হিলি একটু ইতস্তত ভঙ্গিতে বললো, "স্যার আমি কয়েকদিন পর পর মাঝেমাঝে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে যাই।" 

আমি খাতাপত্র গোছানোর ফাঁকে হিলির কথা শুনে কিছুটা চমকে উঠে তার দিকে তাকালাম। হিলির সমস্যার মধ্যে অভিনবত্ব আছে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি চমকালাম হিলির কন্ঠস্বর শুনে। অসম্ভব ভরাট এবং স্পষ্ট কণ্ঠ! টুলের উপর জড়সড় হয়ে বসে থাকা, মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলা এই মানুষটার ব্যক্তিত্বের সাথে কোনভাবেই মেলানো যায় না। এবং খেয়াল করলাম এই দুই বছরে অজস্রবার দেখা হলেও এই প্রথম আমি হিলির কথা শুনলাম! 

ভয়েস এবং টোনের আলাদা একটা ইফেক্ট আছে। আমি চেয়ার ঘুরিয়ে হিলির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলাম, "তুমি মাঝেমাঝে অন্ধ হয়ে যাও?" 

হিলি বললো, "জ্বি স্যার। হঠাৎ হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে যাই। তখন কিছুই দেখতে পাই না। প্রচন্ড ভয় লাগে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি। তারপর একসময় আচানক সবকিছু ঠিক হয়ে যায়।" 

জিগ্যেস করলাম, "তোমার এই সমস্যা কতদিনের?" হিলি সংক্ষিপ্তভাবে জবাব দিল, "অনেকদিন।" 

আমি বললাম, "তারপর? তোমার এই সমস্যার কথা কাউকে বলেছো? কোন ডাক্তার দেখিয়েছো?" 

হিলি বললো, "না। তবে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে বলেছিলাম। উনি একজন ডাক্তারের ঠিকানা দিতে চেয়েছিলেন। তারপর উনি হঠাৎ মারা গেলেন।" 

আমি বললাম, "কীভাবে?" হিলি বললো, "মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করে।" 

আমার ক্ষুদ্র ডাক্তারি জীবনে শোনা সবচেয়ে অদ্ভুত সমস্যা সন্দেহ নেই। তবে আমি খুব দ্রুতই আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। আমার মনে হল দীর্ঘদিন হাসপাতালে নাইটগার্ডের চাকরিতে রাত জেগে আর সাথে কিছু স্বভাবগত অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের কারণে হয়তো হিলির কিছুটা মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। না হলে হস্পিটালে চাকরি করা একটা মানুষ এরকম অদ্ভুত সমস্যায় পড়লে হস্পিটালের কোন ডাক্তারকে না বলে উপজেলার ইঞ্জিনিয়ারকে বলতে যাবে কেন! তারপরও ব্যাপারটা যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে পরিপার্শ্বের ব্যাপারে আমার কৌতূহল দিন দিন সমানুপাতিক হারে কমছে। তাছাড়া নিজের জীবনের প্রফেশনাল-পারসোনাল ঝামেলা। তার উপর প্রতিদিন মানুষের অদ্ভুত সব শারিরীক সমস্যার কথা শুনতে শুনতে আজকাল এতটাই বিরক্ত হয়ে গেছি যে, এখন কেউ যদি এসে বলে আমি কিছুদিন পর পর একবার করে মারা যাই তারপরও অবাক হবো না। আমি ব্যাগপত্র গুছিয়ে হিলিকে বললাম, "এখন তো আর তুমি অন্ধ অবস্থায় নাই। তাই না?" 

হিলি বললো, "না।" 

আমি বললাম, "তাহলে তোমার সমস্যার কথা আরেকদিন শুনবো হিলি। আজ আমার একটা কাজ আছে। আজ আমি যাই।" 

হিলি উত্তর দিলো, "ঠিক আছে স্যার।"

বোরো মৌসুম চলছে। ইদানীং অভ্যাস হয়েছে বিকেলবেলা প্রতিদিন একটু গ্রামের দিকে ঘুরতে যাই। মাঠে মাঠে মানুষের কর্মব্যস্ততা দেখতে বেশ লাগে। যেন নতুন ধানের সাথে নতুন প্রাণের জোয়ার এসেছে! আবহমানকাল ধরেও গ্রাম বাংলার কিছু কিছু ব্যাপার এখনো আগের মতই থেকে গেছে। কৃষিতে প্রযুক্তি এসেছে। সেই প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে গ্রামেও। তবু কোথায় যেন প্রকৃতির সাথে মাটির এই মানুষগুলোর একটা সম্পর্ক থেকে গেছে আগের মতই। দূর থেকে দেখলে শাদা চোখে তেমন একটা বোঝা যায় না, তবে কাছ থেকে খেয়াল করলে কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। কেবল প্রকাশ করতে গেলেই বিপত্তি বাধে। ভাষাটা মনে আসলেও মুখে ঠিকঠাক আসে না।

মধ্যরাত। বেশ কিছুক্ষণ আগে একটা দমকা বাতাস দিয়ে গেছে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। প্রথম প্রহরের সেই ভ্যাপসা গরম ভাবটা কেটে গেছে। বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। আমি ব্যালকনিতে বসে আছি। আমার ইনসমনিয়ার ধাত। ফজরের আগে ঘুম আসে না। গভীর রাত খুব সাধারণ মানুষকেও দার্শনিক বানিয়ে দেয়। বসে বসে এলোমেলো চিন্তায় খাবি খাচ্ছিলাম। আবছা আলোতে দেখলাম কেউ একজন ডরমিটরির দিকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। আমার ডরমিটরি হস্পিটাল চত্বরের এক কোণায়। আশেপাশে কোন কোয়ার্টার নেই। থাকিও আমি একা। কিছুটা ভয় পাওয়ার মতই ব্যাপার। আরেকটু কাছে আসার পর মূর্তিটা স্পষ্ট হল। লোকটা হিলি। এই নির্জন গভীর রাতেও কেমন পায়ের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। দেখলেই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নিচে নেমে যায়। একেবারে কাছে আসার পর দোতলার ব্যালকনি থেকেই জিগ্যেস করলাম, "হিলি এত রাতে কী ব্যাপার?" 

হিলি মাটির দিকে তাকিয়েই জবাব দিল, "স্যার একটু কথা ছিল।" 

আমি বললাম, "এত রাতে কী কথা? কালকে হস্পিটালে বলো।" 

হিলি জবাব দিলো, " স্যার একটু জরুরি কথা।" অগত্যা বললাম, "ঠিক আছে উপরে আস।" 

বেশ খানিকটা ভয় আর শঙ্কা নিয়েই হিলিকে বারান্দায় নিয়ে বসালাম। অদ্ভুত এই লোকটার উপস্থিতিতে একটু আগে মধ্যরাতের উদাস ভাবটা কেটে গিয়ে কেমন একটা গা ছমছমে অস্বস্তি আমাকে গ্রাস করে নিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিলাম। 

জিগ্যেস করলাম, "হিলি চা খাবে?" 

হিলি কিছু না বলে চুপ করে রইলো। আমি ফ্লাস্ক থেকে চা নিয়ে হিলিকে দিলাম সাথে নিজেও নিলাম। নিকোটিনের প্রভাবেই হয়তো সুক্ষ্ম টেনশনের ভাবটা কিছুটা হালকা হয়ে এল। সামনে বসে থাকা এই অদ্ভুত স্বভাবের মানুষটার জন্য হঠাৎ করে একটু মায়া অনুভব করা শুরু করলাম। মনে হল হাজার হাজার সঙ্গীহীন বিনিদ্র রাতের উদ্ভট কল্পনায় তার মনে কত সহস্র গল্প জমা হয়ে আছে কে জানে! হোক না সেসব গল্প বাস্তবতাহীন বিকৃত মস্তিষ্কের কল্পনা। সঙ্গীহীন এই অদ্ভুত মানুষটা আমাকে যদি কিছু কথা বলে শান্তি পায়, তাহলে পাক না একটু শান্তি! 

আমি হিলিকে বললাম, "তুমি যা বলতে চাও বল। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে তোমার কথা শুনছি।" 

হিলি বললো, "মসজিদের ইমাম সাহেব আমার সমস্যার জন্য আমাকে তাবিজ দিতে চাইসিল।" 

আমি বললাম, "তারপর?" 

হিলি বললো, "ইমাম সাহেবও হঠাৎ মারা গেলেন।" 

আমি বললাম, "কিভাবে?" 

হিলি বললো, "ঝড়ের মধ্যে ফজরের নামাজের জন্য বের হয়েছিলেন। পথে গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়লো। দুইদিন পর হস্পিটালে মারা গেলেন।" 

আমি জিগ্যেস করলাম, "কতদিন আগে?" 

হিলি বললো, "দুই বছর আগে।" 

আমি বললাম, "এখন তুমি কি চাও হিলি? আমি তোমার চিকিৎসার জন্য চেষ্টা করি?" 

হিলি বললো, "না।"

 আমি বললাম, "তাহলে তুমি কী চাও?" 

হিলি কোন জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। আমি আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ হিলির দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর খুব শান্তস্বরে বললাম, "ইমাম সাহেবের মৃত্যুর গল্প শোনানোর জন্য এই গভীর রাতে তুমি আমার কাছে আসো নি। তুমি আসলে কী বলতে চাও স্পষ্ট করে খোলাখুলি বল। তোমার কথা শোনার মত ধৈর্য্য আমার প্রতিদিন হবে না। সুতরাং ধরে নিতো পারো এটাই তোমার একমাত্র সুযোগ। যা বলতে চাও বলে ফেল।" 

হিলি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর বললো, "আমি আপনাকে মিথ্যা বলেছি। অন্ধ হওয়ার সময়টাতে আমি দেখতে পাই। তবে আশেপাশের কোনকিছু দেখতে পাই না। মাথার ভিতর ছবি দেখি। টেলিভিশনের মত ছবি।" আমি বললাম, "কিসের ছবি দেখ?" হিলি বললো, "মৃত্যুর ছবি দেখি। খুন খারাবি। এক্সিডেন্ট। অপঘাত মৃত্যুর ছবি দেখি। একেবারে স্পষ্ট ছবি।" 

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিগ্যেস করলাম, "ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আর ইমাম সাহেবের মৃত্যুর ছবিও দেখেছিলে?" 

হিলি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো। 

আমি বললাম, "শুধু এই দুজনের ছবিই দেখেছো নাকি এখনো দেখো?" 

হিলি বললো, " প্রায় প্রায় দেখি। সব অপরিচিত মানুষ। আমি কিছু করতে পারি না। শুধু দেখি আর ছটফট করি। আমার প্রচন্ড কষ্ট হয় স্যার।" 

আমি হিলির দিকে তাকিয়ে বললাম, "এই ছবি দেখার ঘটনা শুরু হওয়ার পর থেকেই কি তুমি মানুষের মুখের দিকে তাকাতে ভয় পাও?" 

হিলি ছোট্ট করে উত্তর দিল, "জ্বি স্যার।" 

আমি আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিলাম। সামনের ল্যাম্পপোস্টের লাইট থেকে হালকা একটা আলো এসে ব্যালকনিতে পড়েছে। তার আবছা আলোতে বসে হিলি নামের এই অদ্ভুত মানুষটার কাছে আমি সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বসে আছি। একটা কুকুর এসে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমাদের দিকে তাকিয়ে খুব বিশ্রীভাবে ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে। এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম বলে খেয়াল করি নি। এখন কেমন যেন অসহ্য লাগছে। গত কয়েকদিন ধরে ঠিক একই সময়ে এসে এই কুকুরটা কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে চলে যায়। কে জানে তার দুঃখ কী! হিলি নামের এই লোকটার মত সেও কী আমার কাছে অদ্ভুত কোন গল্প নিয়ে আসে? সেও কী আমাকে কিছু বলতে চায়? কে জানে! 

নিঃসঙ্গ উপজেলা জীবনের নির্জন মধ্যরাতের এই আধিভৌতিক গা ছমছমে পরিবেশে, মৃত্যুদূতের পাশে বসেও হঠাৎ আমার কাছে জীবনটা অনেকবেশী সুন্দর আর অর্থবহ হয়ে উঠলো। আমার প্রতিদিনের একঘেয়ে রুটিন, মানুষের উদ্ভট শারিরীক উপসর্গের নিরন্তর ফিরিস্তি, ডরমিটরির এইসব ক্লান্তিকর নির্ঘুম রাত সত্বেও বেঁচে থাকাটা অনেকবেশী আনন্দের মনে হল। আমার ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি, শৈশবের সব দুরন্ত দিন, স্কুল, কলেজ, প্রথম ভালোলাগার সেই অদ্ভুত শিহরণ, অনেকদিন আগে একজন মায়াবতীর দীর্ঘ আঁখিপল্লবের সেই একজোড়া চোখ আর অস্পষ্ট মুখাবয়বের কথা মনে করে জীবনটাকে আমার অনেকবেশী আপন আর নিজের মনে হল। রোগশয্যায় আমার পাশে উদ্বিগ্ন মায়ের মমতাময় কোমল হাতের স্পর্শের কথা মনে করে আমার চোখ দিয়ে মনের অজান্তে হয়তো দু'ফোঁটা চোখের পানিও গড়িয়ে পড়লো। 

আমি চেয়ার থেকে হিলির দিকে ঝুঁকে এসে খুব শান্ত স্থির কণ্ঠে জানতে চাইলাম, "তোমার সর্বশেষ ছবিতে কি তুমি আমাকে দেখেছো?" 

এই প্রথম হিলি তার মাটির দিকে ঝুকিয়ে রাখা চোখ তুলে আমার দিকে চাইলো। আমি চমকে উঠে কিছুটা পিছিয়ে এলাম। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোতেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে টকটকে রক্তবর্ণের একজোড়া বীভৎস চোখ! সেই চোখ থেকে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে পানি। রক্তাভ চোখের সেই অশ্রুর রঙ সোডিয়ামের টিমটিমে আলোতে ঠিক ঠাহর করা গেল না।

দক্ষিণের আকাশে ভোরের সূর্য উঠছে। দু'বছর আগে এখানে এসে দিক নিয়ে যে ভ্রান্তিটা মাথার ভেতর ঢুকে গিয়েছিল সেটা এখনো বহাল তবিয়তে বর্তমান আছে। কেমন স্নিগ্ধ লাল টকটকে একটা সূর্য। চাঁদের আলোর স্নিগ্ধতায় ছিল আমার নিত্যদিনের বাস। অজস্র নিদ্রাহীন রাত, এক টুকরো চাঁদের আলো, ক্যাফেইন, নিকোটিন, বইয়ের তাক সবকিছু মিলিয়েই ছিল আমার নিভৃত জীবন। বয়স বেড়েছে; কাজে অকাজে, ইচ্ছা অনিচ্ছায়, আনন্দ বেদনায়, বাইরের পৃথিবী আর পৃথিবীর পরিচিত অপরিচিত জনস্রোতে মিশে গিয়েছি অগুনতি বার। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে দিনশেষে নিজের কাছে ফিরে এসেছি একা। পৃথিবীর কোলাহল, জীবনের ব্যস্ততা, জনস্রোতের পদধ্বনি আমার কানে গিয়ে মস্তিষ্কের অ্যামিগডালায় আটকে গেছে বারবার। স্মৃতিতে পৌঁছাতে পারেনি। আজ এই ভোরের তেজহীন কোমল সূর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আমার কেবলই শৈশবের কথা মনে পড়ছে। অথচ আমি হয়তো দাঁড়িয়ে আছি পড়ন্ত বিকেলের আসন্ন সন্ধ্যার আরেক তেজহীন কমণীয় রক্তাভ সূর্যের উপকন্ঠে!


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল