আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর চালানো ভয়াবহ হামলার পর প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেলেও ঘটনাটির আসল চিত্র এখনও রহস্যে ঢাকা। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। অপরদিকে, তেহরান বলছে, তারা হামলার মুখেও কর্মসূচির মূল কাঠামো অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে।
‘অভূতপূর্ব ধ্বংস’ দাবি ট্রাম্পের
২১ জুন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর মার্কিন বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমানে হামলা চালানো হয়। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র শন পারনেল দাবি করেন, এই হামলায় ইরানের তিনটি মূল পারমাণবিক স্থাপনা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। “আমরা তাদের কর্মসূচিকে অন্তত এক থেকে দুই বছর পিছিয়ে দিয়েছি,”—বলেন পারনেল।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, “ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, যেটা আগে কেউ কখনও দেখেনি।”
তবে কি এতটা সফল ছিল হামলা?
এসব দাবির বিপরীতে গত মাসে ফাঁস হওয়া একটি মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইরানের মূল পারমাণবিক কাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়নি—শুধু কয়েক মাস পিছিয়ে দেওয়া গেছে।
বিশেষ করে ফোর্ডো পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত কিছু জানা যাচ্ছে না। উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে, হামলার আগেই কিছু ট্রাক সেখানে থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ এসব স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি কতটুকু হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়।
আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রোসি জানান, “আমরা জানি না ইউরেনিয়ামের মজুদ কোথায় রয়েছে, বা এর কোনো অংশ কি ওই হামলার সময় ধ্বংস হয়েছে কিনা।” তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, কিছু সংরক্ষণাগার হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আবার কিছু হয়তো সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
আইএইএর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ইরান
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইরান পার্লামেন্ট একটি আইন পাশ করে আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করে দেয়। তাদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানাতে সংস্থাটি ব্যর্থ হয়েছে।
এর আগে তেহরান দাবি করেছিল, তারা এমন কিছু ইসরায়েলি নথি পেয়েছে, যা প্রমাণ করে আইএইএ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে তথ্য ইসরায়েলের কাছে পাচার করেছে। যদিও আইএইএ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তেহরানকে আহ্বান জানায়—তারা যেন পারমাণবিক তদারক সংস্থা আইএইএর সঙ্গে আবারও সহযোগিতায় ফিরে আসে। মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেন, “শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকা অবস্থায় ইরানের এভাবে সহযোগিতা স্থগিত করাটা মেনে নেওয়া যায় না।”
যুদ্ধের পটভূমি ও পরিণতি
১৩ জুন ইসরায়েল, কোনো সরাসরি প্ররোচনা ছাড়াই, ইরানের ওপর ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে। যুক্তি ছিল—ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে অগ্রসর হচ্ছে। পাল্টা জবাবে ইরান একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যাতে ইসরায়েলে ২৯ জন নিহত হয়।
দশম দিনে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেয় এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালায়। জবাবে তেহরান কাতারের একটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে, যদিও এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
এর কয়েক ঘণ্টা পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। ইসরায়েল ও ইরান উভয়ই যুদ্ধের ফলাফলকে “ঐতিহাসিক বিজয়” বলে দাবি করে।
জবাবের ভাষা আলাদা, যুদ্ধ শেষ নয়
ইসরায়েল দাবি করছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। তবে ইরান পাল্টা বলছে—তাদের সরকার, পারমাণবিক কর্মসূচি ও ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রম এখনও অটুট রয়েছে, এবং ইসরায়েলের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে।
এখন পর্যন্ত কোনো নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন পাওয়া যায়নি। তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এখন নজরদারির বাইরে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও, আস্থার সংকট ও অনিশ্চয়তা থেকে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে।
সূত্র: আল-জাজিরা
একে