অ আ আবীর আকাশ, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি:
বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) অর্থায়নে লক্ষ্মীপুরে চলমান টুইন পিট ল্যাট্রিন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। কোটি টাকার এ প্রকল্পে নিয়ম-নীতি উপেক্ষা, ভুয়া নাম ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নামে কাজ বরাদ্দ, নিম্নমানের নির্মাণ এবং ঘুষ–দুর্নীতিসহ নানামুখী অভিযোগ স্থানীয়দের ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলেছে।
* অস্বচ্ছ বরাদ্দ—ভুয়া নাম ও অবসরপ্রাপ্তদের নামে কোটি টাকার কাজ
স্থানীয় সূত্রের দাবি, প্রকল্পের কাজ বরাদ্দে সঠিক ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়নি। এর পরিবর্তে জনস্বাস্থ্যের কিছু কর্মকর্তা নিজেদের ঘনিষ্ঠ, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং এমনকি ভুয়া নাম ব্যবহার করে বরাদ্দ ভাগ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল নিয়ম, যোগ্য ঠিকাদার ও প্রতিষ্ঠান নির্বাচন, আনুষ্ঠানিক দরপত্র—এসব কোনো কিছুই যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন।
তারা অভিযোগ করেন, “যাদের নামে কাজ দেখানো হয়েছে, তাদের অনেকে বাস্তবে কাজ কীভাবে হয়—তা পর্যন্ত জানেন না। অথচ কাগজে তারা বড় বরাদ্দের ‘ঠিকাদার’!”
- এই ধরনের অনিয়ম প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তুলেছে।
- ৯ হাজারের বেশি ল্যাট্রিন নির্মাণের টার্গেট—কাগজে বরাদ্দ, বাস্তবে অনেকে বঞ্চিত
২০২৫ সালের মধ্যে লক্ষ্মীপুরের সদর, রায়পুর ও রামগঞ্জ উপজেলাসহ মোট ৯ হাজার ৩৮৯টি টুইন পিট ল্যাট্রিন নির্মাণের কথা। এর মধ্যে সদরের ২১টি ইউনিয়নে ৪৮০৯টি, রায়পুরের ১০টি ইউনিয়নে ২২৯০টি এবং রামগঞ্জে ২২৯০টি ল্যাট্রিন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
উপকারভোগীর তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় এনজিও ‘জেভি-৩ ড্রপ অ্যান্ড ওয়াটার এইড’–এর প্রতিনিধিদের। কিন্তু স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও নাগরিকদের অভিযোগ—এই তালিকা তৈরিতে স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার প্রভাব ও সুবিধাভোগী মহলের অনুগ্রহ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। অনেক দরিদ্র পরিবার বরাদ্দ না পেলেও কাগজে তাদের নাম দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
একাধিক সুবিধাভোগী অভিযোগ করেন, “আমাদের নামে কাগজে টয়লেট দেখানো হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে আমরা কিছুই পাইনি।”
* নিম্নমানের উপকরণ, অসমাপ্ত কাজ—প্রকল্প জুড়ে অভিযোগের পাহাড়
অভিযোগ রয়েছে, ল্যাট্রিন নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণগুলো নিম্নমানের। অনেক টয়লেট অর্ধেক করে ফেলে রাখা হয়েছে; আবার কোনোটি নির্মাণের কয়েক দিনের মধ্যেই ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।
স্থানীয়দের মতে, বরাদ্দকৃত অর্থের বড় অংশ লুটপাটের কারণে প্রকল্পের মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তারা দাবি করেন, “টাকা বাঁচানোর জন্য ইট, সিমেন্ট, রড—সবকিছুতেই কম মানের জিনিস ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে প্রকল্প হাত না লাগতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
* সংবাদ সংগ্রহে সাংবাদিকদের বাধা—প্রকৌশলীদের আচরণে ক্ষোভ
অনিয়মের বিষয় তদন্তে মাঠে নামা সাংবাদিকদেরও বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। দৈনিক সকালবেলা ও দৈনিক জবাবদিহি—দুই পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, লক্ষ্মীপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের কমলনগর উপজেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. রাকিব ও ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট বেলালের বিরুদ্ধে ‘ফাইল প্রসেসিং’-এর নামে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তদন্ত করতে গেলে রায়পুর উপজেলার সহকারী প্রকৌশলী রমিজ উদ্দিন সাংবাদিকদের কাজ করতে বাধা দেন।
সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তিনি সরকারি কর্মকর্তা হয়েও সাংবাদিকদের পরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, বাকবিতণ্ডায় জড়ান এবং নির্বাহী প্রকৌশলীর নির্দেশ অমান্য করে স্থান ত্যাগ করেন। তার বিরুদ্ধে ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। এইসব ঘটনার জেরে সাংবাদিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
রায়পুরে কাজ বন্ধ—উপকারভোগী ও ইউপি সদস্যদের প্রতিবাদ
রায়পুর উপজেলার ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে পরপর অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর সুবিধাভোগী ও ইউপি সদস্যরা ল্যাট্রিন নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন। এ নিয়ে দৈনিক যুগান্তরে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি আরও ব্যাপক আলোচনায় আসে। অভিযোগ হওয়া সত্ত্বেও বিভাগের উচ্চপদস্থ কারও বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে।
*বিলকিস আক্তারকে ঘিরে পুরোনো অভিযোগ ফের আলোচনায়
টুইন পিট প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগের পাশাপাশি সামনে উঠেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী বিলকিস আক্তারের পুরোনো অভিযোগও। লক্ষ্মীপুরে যোগদানের আগে গাজীপুরে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, বরাদ্দে অস্বচ্ছতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠে আসে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
স্থানীয় সচেতন মহল বলছে, “বারবার একই ধরনের অভিযোগ ওঠার পরও পদক্ষেপ না নেওয়া হচ্ছে কেন? দায়মুক্তির সংস্কৃতি বজায় থাকলে দুর্নীতি বন্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
* অভিযোগ অস্বীকার—তদন্ত দাবি তীব্রতর
বিলকিস আক্তার সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সবকিছু নিয়ম মেনেই করা হয়েছে এবং অভিযোগগুলো উদ্দেশ্যমূলক। তবে স্থানীয়দের দাবি, তদন্ত ছাড়া সত্য উদঘাটন সম্ভব নয়। তারা দ্রুত উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
* দুর্নীতির জাল ছিন্ন না হলে প্রকল্প ব্যর্থতার শঙ্কা
বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে এবং দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের জন্য গৃহীত এই প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক ও এআইআইবির অর্থায়িত এ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
*সচেতন নাগরিকের দাবি—
“স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও কঠোর নজরদারিই পারে প্রকল্পটিকে বাঁচাতে। নয়তো কোটি টাকার এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির বলি হবে।”
এমআই