নিজস্ব প্রতিবেদক:
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমান্বয়ে কমছে। কয়েক বছর ধরে লাভে রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সব খরচ বাদ দিয়ে বিপিসি নিট মুনাফা করেছে চার হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। এই অবস্থায় মূল্য সমন্বয় করে তেলের দাম কমানোর পরিবর্তে বাড়ানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতি লিটার তেলের দাম দুই টাকা বাড়িয়েছে। গতকাল সোমবার নতুন মূল্য কার্যকর হয়েছে। ডিজেলের দাম ১০২ থেকে বাড়িয়ে ১০৪ টাকা, পেট্রোলের দাম প্রতি লিটার ১১৮ থেকে বাড়িয়ে ১২০ ও অকটেন ১২২ থেকে বাড়িয়ে ১২৪ টাকা করা হয়েছে। কেরোসিনের দাম প্রতি লিটার ১১৪ থেকে বাড়িয়ে ১১৬ টাকা করা হয়।
বিপিসি লাভে থাকলেও বিষয়টি খুব একটা সামনে আনা হয় না। সংস্থাটির কয়েক বছরের লাভ-লোকসানের নিরীক্ষা তথ্য সংগ্রহ করেছে সমকাল। এতে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারকে কর দেওয়া ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানসহ সব খরচ বাদ দিয়ে নিট মুনাফা করেছে চার হাজার ৩১৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। ওই সময়ে টার্নওভার ছিল ৭২ হাজার ৩৬৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিট মুনাফা করেছে তিন হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে মুনাফা করেছে দুই হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে নভেম্বর মাসজুড়ে ব্যারেলপ্রতি ব্রেন্ট ক্রুডের মূল্য গড়ে ৬০ ডলারের মধ্যে ছিল। গত ৫২ সপ্তাহে ব্রেন্ট ক্রুডের সর্বনিম্ন মূল্য ছিল ৫৮ দশমিক ৪০ ডলার এবং সর্বোচ্চ ছিল ৮২ দশমিক ৬৩ ডলার। পাশাপাশি ডব্লিউটিআই ক্রুডের মূল্য গত এক মাসে সর্বনিম্ন ৫৮ ডলার ৩৩ সেন্টে নেমে আসে। মূলত চলতি বছরের মাঝামাঝি থেকে তেলের মূল্য কমতে থাকে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল ৬৩ দশমিক ৩৩ ডলার। ডব্লিউটিআই ক্রুড ৬২ দশমিক ২০ ডলার এবং মারবান ক্রুডের দাম ছিল ৬৫ দশমিক ৩৫ ডলার।
এ ব্যাপারে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য প্রফেসর মুহাম্মদ সেকান্দার খান সমকালকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো-কমানোর কথা। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমেছে। অন্যদিকে বছর বছর লাভও করছে বিপিসি। তেলের মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই দুটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। দাম না কমিয়ে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য লিটারে দুই টাকা করে বাড়িয়েছে। বর্ধিত এই মূল্য ভোক্তা পর্যায়ে বড় কোনো প্রভাব ফেলার কথা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে তেলের দাম বাড়লেই বিভিন্ন পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়টি সরকারকে নজরে রাখতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমে আসা এবং লাভে থাকার পরও তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিপিসির পরিচালক (অর্থ) নাজনীন পারভীন সমকালকে বলেন, ‘বিপিসি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয় করে দেশে মূল্য নির্ধারণ করে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বাড়ছে। তবে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভোক্তার বিষয়টিও মাথায় রাখা হয়।’ এ বিষয়ে আরও তথ্য জানতে চাইলে সংস্থার চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। তবে বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসানের (সচিব) মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
সাধারণত তেলের দাম বাড়ানো ও কমানোর ক্ষেত্রে বিপিসি থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। এটি বিবেচনা করে মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বিপিসির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো-কমানো খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও বিষয়টি অবহিত করা হয়। এরপর সিদ্ধান্ত হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারেও প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়। কিন্তু মূল্য যেভাবে বাড়ানো হয়, সেভাবে কমানো হয় না। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে দেশে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো হচ্ছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও তেলের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। বিপিসি তেল আমদানিতে রপ্তানিকারকদের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে চুক্তি করে। যখন চুক্তি করা হয়, তখনকার বাজারমূল্য আমলে নেওয়া হয়। তবে এ ক্ষেত্রে দরকষাকষিও হয়।
একে