মো. রামিন কাউছার:
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এই ছয় ঋতুর মধ্যে শীতকাল অন্যতম। শীত প্রকৃতিতে নিয়ে আসে এক বৈচিত্র্যময় পরিবর্তন। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস নিয়ে শীতকাল হলেও এর আগেই প্রকৃতিতে মৃদু শীতের আগমন ঘটে। ঢাকার অদূরে সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে খ্যাত, নৈসর্গিক ও অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যেন তারই জীবন্ত উদাহরণ। শীতকে আপন করে নিতে এখানকার প্রকৃতি যেন এক নান্দনিক রূপ ধারণ করে।
ঢাকার মতো একটি ব্যস্ত ও জনবহুল নগরীতে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি শিক্ষার্থী এবং এখানকার অধিবাসীদের অকৃত্রিম ভালোবাসা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আধুনিক গ্রামে পরিণত করেছে। তাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শীতের আগমন গ্রাম্য পরিবেশের মতোই উপভোগ্য।
সকালে ঘুম ভাঙার পর জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই দেখা যায় কুয়াশায় আচ্ছন্ন প্রকৃতি। কিছুক্ষণ পর সেই কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের ক্ষীণ আলো রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। আর আলো ও পাখির কূজনেই ঘুম ভেঙে যায়। ভোরবেলায় শিশিরে ভেজা মাঠ–ঘাট–প্রান্তর আর কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে ক্যাম্পাসে হাঁটলে এক স্বর্গীয় অনুভূতি আসে। সকালে জাবির কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ,সিডনি মাঠ ও ভিসি মাঠে হাঁটলে শিশিরে পা ভিজে যায়। পাশাপাশি মনে হয় এক অপার্থিব অনুভূতির ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে।
জাবিতে শীতের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ অতিথি পাখি। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। জাবির ছোট-বড় ২৬টি লেক যেন আগেই তাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকে। লাল পদ্মফুলে সেজে ওঠে লেকগুলো। অতিথি পাখিদের জন্য কৃত্রিমভাবে বাঁশের তৈরি মাছাও স্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ করে মনপুরা লেক, জাহানারা ইমাম হল সংলগ্ন লেক, প্রীতিলতা হল সংলগ্ন লেক, ট্রান্সপোর্ট চত্বর সংলগ্ন লেক এসব স্থান যেন অতিথি পাখিদের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। পাখিরা দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায়, পানিতে ডুব দেয়, উড়ে বেড়ায়, আবার লোকচুরিতেও মেতে ওঠে। তাদের কলরবে পুরো ক্যাম্পাস মুখরিত হয়ে ওঠে। এজন্যই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় অতিথি পাখির ক্যাম্পাস। অতিথি পাখিদের নান্দনিক দৃশ্য দেখতে শিক্ষার্থীরা এসব স্থানে ভিড় করে। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে বা মানসিক প্রশান্তি পেতে শীতকালে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন লেকের ধারে সময় কাটায়। শুধু শিক্ষার্থী নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষও শীতের এই নৈসর্গিক, সবুজে মোড়া রাজ্য দেখতে জাবিতে আসে। বিশেষ করে পর্যটক ও ফটোগ্রাফাররা দূর-দূরান্ত থেকে এসে দৃশ্যগুলো কাছ থেকে উপভোগ ও সংরক্ষণ করে রাখে।
শীতকালে সারা দেশে পিঠার উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় থাকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও এর ব্যতিক্রম নয়। শীতকালে জাবির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নানা বৈচিত্র্যের পিঠা-পুলি। এ সময় ক্যাম্পাসে পিঠাকে ঘিরে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পিঠা।পিঠা পছন্দ করে না এমন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর। অগ্রহায়ণ-পৌষে কৃষকের ঘরে নতুন ধান ওঠে, শুরু হয় নবান্ন উৎসব। আর নবান্নের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পিঠা। নতুন ধানের চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় নানান ধরনের পিঠা।
জাবিতেও পিঠার চাহিদা মেটাতে বটতলা, টারজান,কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারসংলগ্ন এলাকা, মুরাদ চত্বর, অমর একুশে, মেডিকেল সেন্টারসংলগ্ন পিঠা চত্বরসহ বিভিন্ন হল চত্বরে পিঠার দোকান বসে। এসব দোকান শিক্ষার্থীদের মায়ের হাতের পিঠার স্বাদ অনেকটাই পূরণ করে। গ্রামীণ অঞ্চলের মতো মাটির চুলায় কাঠের লাকড়ির আগুনে পিঠা তৈরির ঐতিহ্যও বজায় থাকে। দোকানগুলোতে ভাঁপা, চিতই, ডিম চিতই, পাটিসাপটা, নকশি পিঠা, তেলের পিঠা, মাংসের পিঠা, সবজি পিঠা, পুলি পিঠাসহ নানা রকম পিঠা তৈরি হয়। বিকাল থেকেই এসব দোকানে শিক্ষার্থীদের ভিড় জমে। বিশেষ করে পিঠা চত্বরের দোকানে পিঠা খেতে লাইনে দাঁড়াতে হয়। এসব পিঠার স্বাদ নিতে সাবেক শিক্ষার্থীরাও পরিবারসহ চলে আসেন।
এছাড়াও জাবির কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ,সিডনি মাঠ ও ভিসি মাঠসহ বিভিন্ন জায়গায় খেলাধুলার আসর শুরু হয়।পাশাপাশি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল, মওলানা ভাসানী হল, বীর প্রতীক তারামন বিবি হল, প্রীতিলতা হলসহ বিভিন্ন হলে আয়োজন করা হয় নানা ধরনের খেলাধুলার উৎসব।এর মধ্যে অন্যতম র্যাকেট খেলা, শর্টপিচ ক্রিকেট ও ফুটবল টুর্নামেন্ট ইত্যাদি।
এভাবেই শীত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসে এক বৈচিত্র্যময়, নান্দনিক ও উৎসবমুখর পরিবেশ।
এমআই