আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যেই বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) টেলিফোনে কথা বলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফোনালাপের মাধ্যমে দুই নেতা নিজেদের 'যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প শক্তি' হিসেবে উপস্থাপন এবং শান্তির পক্ষে অবস্থান নেওয়ার বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপে যুক্ত হওয়ার চিন্তা করছেন, তখন এই সংঘাত বিশ্বরাজনীতিতে বেইজিং ও মস্কোর জন্য নিজেদের যুক্তরাষ্ট্রের 'বিকল্প শক্তি' হিসেবে দেখানোর নতুন একটি সুযোগ এনে দিয়েছে।
ক্রেমলিনের বরাতে জানা গেছে, ফোনালাপে পুতিন ও শি জোরালোভাবে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানান এবং এটিকে জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেন। যদিও রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন এবং তাতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি আলোচনায় আসেনি—যা চীন কখনও প্রকাশ্যে সমালোচনা করেনি।
বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে ফোনালাপের যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তাতে শি অপেক্ষাকৃত মিতভাষী ছিলেন এবং পুতিনের মতো ইসরায়েলকে সরাসরি অভিযুক্ত করেননি। তবে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত সপ্তাহে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপে ইসরায়েলের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।
শি তার বিবৃতিতে বলেন, সংঘর্ষরত পক্ষগুলো, বিশেষ করে ইসরায়েলকে, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মাধ্যমে সংঘাত প্রশমনের উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে এটি আরও ছড়িয়ে না পড়ে এবং অঞ্চলে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি না করে।
বিশেষভাবে তিনি বলেন, 'যেসব বৃহৎ শক্তির এই সংঘাতের ওপর প্রভাব রয়েছে, তাদের উচিত পরিস্থিতিকে শান্ত করা, উসকে দেওয়া নয়।' বিশ্লেষকদের মতে, এই মন্তব্য ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত, যা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বলে চীন মনে করে।
সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিউ ঝংমিন বলেন, 'ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ ও তার নীতিনির্ধারণী বিশৃঙ্খলা, সুবিধাবাদিতা এবং লেনদেনভিত্তিক আচরণই এই সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে।'
রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে লিউ লিখেছেন, 'ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করেছেন, মিত্রদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি দুর্বল করেছেন এবং শত্রুদের জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শনের সক্ষমতাও কমিয়ে দিয়েছেন।'
অনেক চীনা অনলাইন বিশ্লেষক মনে করছেন, ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি 'চিরস্থায়ী যুদ্ধাবস্থা'-এর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা বারবার বলেছিলেন, ওয়াশিংটনকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের আগ্রাসী নীতির মোকাবিলায় মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু পাঁচ মাস পার হওয়ার পর ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধ এখনো থামেনি, উল্টো ট্রাম্প এখন ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধেও জড়ানোর চিন্তা করছেন। চীন এই অঞ্চলে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ চায় না, বিশেষ করে এমন একটি সংঘাত যেখানে ইরানের সরকার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির নেতৃত্বে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের পাল্টা ভারসাম্য তৈরি করেছে। চীনও এই অঞ্চলে নিজের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
২০২৩ সালে চীন সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে মধ্যস্থতা করে। এটি তাদের এই অঞ্চলে নতুন শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
চীন দীর্ঘদিন ধরে ইরান থেকে তেল আমদানি ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ ব্যবহার করে ইরানকে সমর্থন দিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন-ইরান কৌশলগত সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাশিয়াসহ যৌথ নৌ-মহড়া আয়োজন, ইরানকে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) ও ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত করা। স্পষ্টত, এই দুটি জোটই চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন একটি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্রিয়।