নিজস্ব প্রতিবেদক:
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) বর্তমানে এক ধরনের অস্থিরতা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। সংস্কারের দাবিতে কর্মবিরতি ও শাটডাউন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা এখন একে একে শাস্তির মুখে পড়ছেন। কোনো কোনো কর্মকর্তা আত্মপশ্চাতাপবোধে ভুগছেন, কেউবা চেয়ারম্যানের দৃষ্টি অনুকূলে আসতে চেষ্টা করছেন—সব মিলিয়ে এনবিআরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশে তৈরি হয়েছে এক থমথমে অবস্থা।
চলতি মাসের শুরুতেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এনবিআরের ১৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর সদস্য এবং আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। আন্দোলন স্থগিতের এক সপ্তাহ না যেতেই ৫ জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এতে বাড়ছে উৎকণ্ঠা ও গুজব।
বিশেষ করে কর ফাঁকির মামলায় ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে জড়িত থাকার অভিযোগে তদন্তের আওতায় এসেছে যেসব নাম, তাদের অনেকে এখন চাকরি বাঁচাতে শীর্ষ কর্মকর্তার কাছে দয়াপ্রার্থনা করছেন। কেউ কেউ আবার ‘গণক্ষমা’ ঘোষণার সম্ভাবনাও বিবেচনায় রেখেছেন।
দুদকের দাবি অনুযায়ী, যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে, তারা বিভিন্ন কর অঞ্চলে দায়িত্ব পালনের সময় করদাতাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন। কেউ কেউ ঘুষ না পেয়ে উল্টো হয়রানিমূলক মামলা করে নিরীহ ব্যবসায়ীদের বিপাকে ফেলেছেন। এর ফলে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে।
এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আন্দোলনের সময় অনেক কিছু না ভেবেই হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কেউ ফোন বন্ধ রেখেছেন, কেউ আন্দোলনের গ্রুপ ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে মনে করছেন—এটি ছিল একটি কৌশলগত ভুল।
এনবিআরের এক সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ভাবি, আজ কি আমার পালা? অনিশ্চয়তায় আছি। অথচ আমরা মেধাবী ও সৎভাবে কাজ করেছি বলে দাবি করি। কিন্তু পরিস্থিতি যেন আমাদের মুখের উপর চপেটাঘাত।’
অন্যদিকে, একজন মহাপরিচালক স্বীকার করেন, ‘আমি সরাসরি আন্দোলনে ছিলাম না, তবে কোনো একভাবে গ্রুপে যুক্ত হয়েছিলাম। এখন খুবই চিন্তিত। মনে হচ্ছে, এটাই কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
জানা গেছে, শাস্তির আওতায় আসা বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা আন্দোলনের পরিকল্পক ছিলেন। সেহেলা সিদ্দিকা, হাছান তারেক রিকাবদার, মির্জা আশিক রানা, মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা—এসব পরিচিত মুখের অনেকেই এখন দুদকের অনুসন্ধানে। গত ১ থেকে ৩ জুলাইয়ের মধ্যে অন্তত ১৬ জনের বিরুদ্ধে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ এনবিআরের সদস্য পর্যায়ের কর্মকর্তা।
এদিকে বদলির তালিকাও ছোট নয়। গত জুন মাসের শেষ দিকে অন্তত ৬ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। এর আগেই বরখাস্ত হয়েছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার জাকির হোসেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ—সরকারি নির্দেশ অমান্য করে কার্যক্রম বন্ধ রাখা। একইসঙ্গে ৪ জন সদস্যকে ‘জনস্বার্থে’ অবসরে পাঠানো হয়েছে, যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছিল।
এসব বিষয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও, ৩০ জুন এক অনানুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলেন, ‘আন্দোলনের ফলে রাজস্ব সংগ্রহে ব্যাঘাত ঘটেছে। এখন আমাদের অতীত ভুলে গিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
অন্যদিকে ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের পাশে থেকে গঠনমূলক সংস্কারে মনোযোগ দিতে হবে। বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘প্রথমেই কাঠামোগত সংস্কার দরকার। তার আগে পরিবেশ শান্ত হওয়া জরুরি।’
প্রসঙ্গত, গত ১২ মে সরকার হঠাৎ করে এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারি করলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে রাজস্ব প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পরে আন্দোলনের মুখে সরকার ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে এনবিআরকে আরও শক্তিশালী করার ঘোষণা দেয়। যদিও আন্দোলনকারীরা ততদিনে চেয়ারম্যানকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে ফেলেছেন। সেনা ও পুলিশের কড়া নিরাপত্তায় পরে অফিসে ফেরেন চেয়ারম্যান।
বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। যারা রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন, আজ তারা ভাগ্য নিয়ে শঙ্কিত। কেউ ভেঙে পড়েছেন, কেউবা ক্ষমা চাইছেন। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—এই আলোড়নের শেষ পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
একে