নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশের উপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পারস্পরিক কমাতে দেশটি থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্ক, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রক শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অন্যান্য অংশীজনের সাথে আলোচনা করে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধান বিবেচ্য বাণিজ্য স্বার্থ সংরক্ষণ করা, এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের যে বিদ্যমান বাণিজ্য আছে সেটি রক্ষা করা।
আজ মঙ্গলবার (৮ জুলাই) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বাণিজ্য সচিব এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক কমানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে সরকারিখাতে খাদ্যশস্য কেনায় যুক্তরাষ্ট্রকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে উড়োজাহাজ এবং সামরিক সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
বাণিজ্যসচিব বলেন, "৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র এবিষয়ে ট্যারিফ সিডিউল ডকুমেন্ট পাঠিয়েছে। এটা আমরা আগেই চেয়েছিলাম। এই নথির ওপরই মূলত আলোচনা হবে আগামী মিটিংয়ে। এই ট্যারিফ সিডিউল আগের এগ্রিমেন্টের একটা এক্সটেনশন বলতে পারেন। আলোচনার দরজা যেহেতু খোলা আছে, কাজেই কিছু একটা আউটকাম তো আমরা আশা করি।"
বাংলাদেশের যুক্তিগুলো কী কী থাকবে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মোটা দাগে আমাদের যুক্তিগুলো থাকবে প্রথমত শুল্ক কমানো এবং দ্বিতীয়ত, আমাদের বানিজ্য-সংক্রান্ত আরও যে ইস্যুগুলো আছে— সেগুলোর কারণে আমরা যাতে অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে না পড়ি।
ট্রাম্পের দেওয়া চিঠির ব্যাপারে তিনি বলেন, এই চিঠিতে যা যা উল্লেখ করেছে, মানে মঙ্গলবার যে ডকুমেন্ট পেয়েছি তাতে যা ছাড় চেয়েছে তারা, সেগুলো অবশ্য আগেই প্রমিস করেছি এবং সেগুলোর ওপর এমনিতেও শুল্ক খুব কম। যেমন গম, সয়াবিন, উড়োজাহাজ, অন্যান্য মেশিনারি এগুলোর ওপর এমনিতেই শুল্ক হার খুব কম। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়ানো দরকার। সেটা না বাড়ালে তো আসলে তারা আমাদের কোনো ধরনের ছাড় দেবে না। কাজেই আলাপ-আলোচনা করে, কিছু ছাড় দিতে সম্মত হতেই হবে।
কীভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানো হবে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে বাণিজ্য যেটা ব্যবসায়ীরা করেন, ওটা তারা সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু সরকারি বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য আমরা যেগুলো ফ্যাসিলিটেড করব, যেমন আপনারা জানেন যে, আমাদের বিমান বহরের প্রায় সব এয়ারক্রাফট বোয়িংয়ের। আমাদের বিমানের অবকাঠামো যা আছে, সেটাও বোয়িংয়ের। বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ কেনার জন্য আমাদের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা সেভাবে আলোচনাও করেছি বোয়িংয়ের সঙ্গে। এছাড়া তুলা আমদানিকে প্রমোট করা হচ্ছে। আমেরিকান তুলা আমদানি যাতে বেশি হয় সেজন্য কিছু ফ্যাসিলিটি এখানে তৈরি করব।
সচিব বলেন, সরকারিখাতে যে সব খাদ্যশস্য কেনা হয়—সেক্ষেত্রে আমরা আমেরিকাকে একটু প্রাধান্য দেব। এভাবে আমরা আসলে আমেরিকান ট্রেডটা বাড়াব। আপনারা জানেন যে আমাদের মিলিটারি ইকুইপমেন্টের একটা বড় অংশ আসে আমেরিকা থেকে। সেসব বিষয়ও বিবেচনায় রয়েছে।
মিলিটারি ইকুইপমেন্ট বলতে কী বোঝাচ্ছেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "আমাদের মিলিটারি হার্ডওয়্যার বলতে যেটা বোঝায়, সেটা হলো আমাদের ভেহিক্যালগুলো, আর্মার্ড ভ্যাহিক্যাল অ্যান্ড আদারস। আমাদের যা যা সংগ্রহ করা হয়, এর বেশিরভাগ আমেরিকা থেকে করা হয়। ওখানে তাদের দিক থেকে কোনো চাপ নেই। তারা বলেছে যে যখন কেনা হবে, আমরা যেন তাদের গুরুত্ব দেই। এ ব্যাপারে তাদের কোনো বিশেষ দাবি নেই যে, আমরা যেন তাদের প্রাধান্য দেই। অন্য মেশিনারিজের ক্ষেত্রেও সে কথা তারা বলেছে। আমাদেরও তাতে সম্মত হতে অসুবিধা নেই।"
তুলার ওপর অগ্রিম আয়কর (এআইটি) নিয়ে করা এক প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, " তুলার ওপর ২ শতাংশ এআইটি আরোপ করা, এটা এ বছর নতুন নয়। এটা নিয়ে আলোচনা চলছে। আমাদের তুলা খাতের, বিশেষ করে টেক্সটাইল খাতের যারা অংশীজন তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছেন। সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কিছু একটা আসবে। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। বাইলেটারাল ট্রেডে সবসময়ই নেগোসিয়েশন পর্যায়ে কিছু ছাড় দেওয়া হয়।"
ভিয়েতনাম আলোচনার মাধ্যমে ২৬ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছে। সেখানে আলোচনায় বাংলাদেশের খুব বেশি তৎপরতা দেখা যায়নি। সাংবাদিকের পক্ষ থেকে এমন কথা বলা হলে তিনি বলেন, "তৎপরতায় পার্থক্য আছে, এটা মনে করি না। কারণ হলো আপনারা এটা জানেন কি না, যেদিন থেকে পাল্টা শুল্ক আরোপ হয়েছে, তারপরে আমাদের প্রধান উপদেষ্টার চিঠি দিয়েছেন, বাণিজ্য উপদেষ্টা চিঠি দিয়েছেন, আমি-ও দিয়েছি। প্রায় পাঁচ দফা মিটিং করেছি, অনলাইনে এবং অফলাইনে। এরপর যে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের খসড়া পাঠিয়েছে সেগুলোর ওপর তিন দফা, গতদিন মিলে চার দফায় আমরা সেই খসড়ার ওপরে সংশোধনী পাঠিয়েছি, সেগুলোর ওপরে আলোচনা করেছি। এছাড়া ইমেইল যোগাযোগ বা টেলিফোন যোগাযোগে এগুলো চলছে। কাজেই আমরা একদম ফুলটাইম এনগেজড ছিলাম গত ২ এপ্রিল থেকে। আমরা এনগেজড না বা তৎপর কম এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না।"
গতকাল যে ৩৫ শতাংশের চিঠিটা হবে এটা আমরা আশা করিনি উল্লেখ করে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, কারণ আমাদের এই সপ্তাহে যে ৮, ৯, ১০, ১১, ১২ তারিখের মিটিংগুলো নির্ধারিত ছিল—সেসব মিটিংয়ের সময় এই চিঠিটা সম্পর্কে কিছু জানতাম না।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক কমাতে না পারলে আমাদের আমদানি-রপ্তানির ওপর চাপ পড়বে কি না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, "প্রেশার হবে, সেটা তো সবাই বোঝে এবং সেটা যাতে না হয়— সে জন্য আমরা যাচ্ছি আলোচনা করতে। আশা করছি, ভালো কিছুই পাব।"
আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সামনে এক মাস রেখে আজ ডকুমেন্ট হ্যান্ডওভার করা হয়েছে, এবং তাদের পক্ষ থেকেই আলোচনার তারিখ দেওয়া হয়েছে। তার মানে নেগোসিয়েশনের দরজা খোলা। "আমরা নেগোসিয়েশনে এনগেজড হচ্ছি, কথা বলছি। আমার উপদেষ্টা সেখানে আছেন। আমি আজ সন্ধ্যায় যাচ্ছি। আমরা কিছু একটা ফলাফল পাবো না—এরকম আশা করে তো আর সেখানে যাচ্ছি না। আশা করি কিছু একটা ফলাফল পাব আলোচনা করে।"
এমআই