বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫

তিস্তা সেতু রক্ষা বাঁধে ধস, বাড়ছে ভাঙন আতঙ্ক

বৃহস্পতিবার, আগস্ট ১৪, ২০২৫
তিস্তা সেতু রক্ষা বাঁধে ধস, বাড়ছে ভাঙন আতঙ্ক

নিজস্ব প্রতিনিধি:

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুরে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় সড়ক সেতুর পশ্চিম তীরে সেতু রক্ষা বাঁধের প্রায় ৬০ মিটার এলাকা ধসে পড়েছে। এতে বাঁধে প্রায় ৭০ ফুট গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে স্রোতের ক্ষিপ্ত শব্দে ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে লালমনিরহাট–রংপুর সড়কসহ পার্শ্ববর্তী হাজারের বেশি পরিবারের বসতবাড়ি।

বুধবার (১৩ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা গেছে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টিপাতের পানি হু হু করে বাড়ছে তিস্তার বুকে। এতে তিস্তা সেতুর পশ্চিম পাশের প্রায় ৯০০ মিটার দীর্ঘ সেতু রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন অংশে আঘাত হানছে তীব্র স্রোতের ধাক্কা। বাঁধের নিচের মাটি ধুয়ে গিয়ে ব্লকগুলো ধসে পড়ছে। বর্তমানে বাকি ব্লকগুলোও ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে।

দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পুরো বাঁধ ভেঙে গিয়ে সেতু ও যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। মহিপুর এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, গত দুই বারের বন্যায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও রক্ষণাবেক্ষণ কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এবার নদীতে পানি আসা মাত্রই বাঁধের ৬০ মিটার জায়গা ধসে গিয়ে বিশাল গর্ত হয়েছে। এতে তিন গ্রামের প্রায় এক হাজারের বেশি পরিবার ও সেতুটি ক্ষতির মুখে পড়েছে। আমরা এখনো পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো উদ্যোগ দেখিনি। সবকিছু বিলীন হওয়ার পর তারা পরিদর্শনে আসে।

আনসার আলী আরেক বাসিন্দা বলেন, নদীর পানি বাড়া-কমাতে ভাঙন শুরু হয়েছে। সেতু রক্ষা বাঁধ ভাঙছে। এলাকার জমিগুলোও তো ভেঙে গেছে। কত দিন ধরে শুনে আসছি যেন তিস্তা প্রজেক্ট হবে, কিন্তু হয় তো আর না।

২০১৮ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) প্রায় ১২১ কোটি টাকা ব্যয়ে গঙ্গাচড়ার মহিপুরে তিস্তার ওপর দ্বিতীয় সড়ক সেতুটি নির্মাণ করে। সেতুটি রংপুর–লালমনিরহাট জেলার মধ্যে যোগাযোগ সহজ করেছে। কিন্তু বর্তমান ভাঙন যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে সেতু ও সংলগ্ন সড়ক মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।

এ ব্যাপারে লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, এর আগে দুইবার বন্যায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম, কিন্তু তারা পদক্ষেপ নেয়নি। এবারও তীব্র স্রোতে বাঁধে আঘাত লাগছে, উজানে আরও বৃষ্টি হলে বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। তখন পানি সরাসরি লালমনিরহাট–রংপুর সড়কে আঘাত করবে, যা ভেঙে গেলে ৩০ লাখ মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবে। পাশাপাশি তিনটি গ্রামের অন্তত দেড় হাজার পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

এ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেউ ফোন রিসিভ করেননি। ফলে ভাঙন রোধে কোনো জরুরি উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা, তা জানা যায়নি।

এদিকে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপ চরের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধির কারণে বন্যার আশঙ্কা করছেন নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষজন।

লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলী গ্রামের কুমোবালা বলেন, সকাল থেকে বাড়িতে পানি উঠতে শুরু করে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। এর আগে পানি উঠে দুই দিন কষ্টে থাকলেও কোনো সহায়তা পাইনি।

গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী, গজঘন্টা ও মর্ণেয়া ইউনিয়ন, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, টেপামধুপুর ইউনিয়ন এবং পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নে তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর, দ্বীপচরের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। বন্যার আশঙ্কায় অনেকে ঘরবাড়ি নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।

কোলকোন্দ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়নের বিনবিনা, শখের বাজার, খলাইর চর, মটুকপুর, আবুলিয়া, চিলাখাল এলাকায় পানি ঢুকে পড়ায় এসব এলাকার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা এলাকার জামাল মিয়া বলেন, রাতে নদীর পানি ছিল না। সকাল থেকে পানি বাড়তে শুরু করে। দুপুরের মধ্যেই  ঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। গরু বাছুর নিয়ে খুব বিপদে পড়েছি। সব জায়গা ডুবে গেছে কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই।

মর্ণেয়া ইউনিয়নের আনছারটারী এলাকার আলেফ উদ্দীন বলেন, তিস্তার পানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় পানিতে ডুবে গেছে  বসতবাড়ি, গবাদিপশুর চারণভূমি পানিতে ডুবে যাওয়ায় পশু খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।

মর্ণেয়া ইউপি সদস্য মজমুল হক ভেগল বলেন, বন্যা হলেই মর্ণেয়ার ভাঙ্গাগড়া চর, তালপট্টি নরসিং, নিলারপাড়া এলাকার মানুষগুলো খুব কষ্টে থাকে। এখন নদীতে পানি বাড়ায়  প্রায় দুই'শ বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে।

নোহালী ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ আলী বলেন, ইউনিয়নের চর নোহালী, চর বাগডহরা, চর বৈরাতি, মিনার বাজার, ব্রিফ বাজার ও আশ্রয়ণ বাজার এলাকার নিম্নাঞ্চলের পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

গঙ্গাচড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান মৃধা বলেন, বন্যায় তিস্তার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্যদিকে গত কয়েকদিনে পীরগাছা উপজেলার তিস্তা নদী বেষ্টিত ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেবসহ আশপাশের এলাকায় শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। শুধু শিবদেব গ্রামেই সাম্প্রতিক ভাঙনে কমপক্ষে ৪৯টি বসতবাড়ি, একটি ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ও একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তিস্তার ভাঙনে হারিয়ে গেছে।

স্থানীয়রা জানান, তীব্র স্রোত ও অব্যাহত ভাঙনের কারণে অনেক পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে, আবার কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।

নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ৩০ পরিবারের মাঝে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবারকে এক বান্ডিল ঢেউটিন ও নগদ ৩ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।

ক্ষতিগ্রস্ত মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, নদী ভাঙনে সব হারিয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে আছি। উপজেলা থেকে  ঢেউটিন আর টাকা দিয়ে অন্তত সাময়িকভাবে থাকার ব্যবস্থা করতে পারব।

ভাঙন প্রতিরোধে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন নদীপাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা। তাদের মতে, সাময়িক সহায়তা জরুরি হলেও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ ব্যবস্থা না হলে প্রতিবছর একইভাবে ক্ষতির মুখে পড়বেন তারা।

এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র, বাপাউবো জানিয়েছে, বুধ ও বৃহস্পতিবার রংপুর অঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের সংলগ্ন অঞ্চলে বন্যা ঝুঁকি আছে। একই সময়ে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও পদ্মা অববাহিকার নদ-নদীসমূহ  সতর্ক সীমায় প্রবাহিত হতে পারে এবং পদ্মা নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল সাময়িকভাবে প্লাবিত হতে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়ে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেই সঙ্গে উজানে ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। বুধবারও দিনভর রংপুর বিভাগে এবং তিস্তার উজানে দিনভর বৃষ্টিপাত হয়েছে।

একে 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল