লাইফস্টাইল ডেস্ক:
আজকের দিনে সৌন্দর্যের মানে পাল্টে যাচ্ছে। আগে যেখানে চোখের নিচের কালো দাগ, ম্লান ত্বক কিংবা ক্লান্ত মুখ লুকাতে নানান প্রসাধনী ব্যবহার করা হত, এখন অনেক তরুণ-তরুণী সেগুলোকেই সৌন্দর্যের অংশ করে তুলছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকে ছড়িয়ে পড়া এই নতুন মেইকআপ ধারা পরিচিত হয়েছে ‘টায়ার্ড গার্ল’ নামে।
নামের মতোই এর মূল লক্ষ্য হল ক্লান্ত, না ঘুমানো বা অলস চেহারাকেই ফ্যাশনেবলভাবে উপস্থাপন করা।
ট্রেন্ডের সূচনা ও প্রভাবশালী মুখ
এই ধারার সবচেয়ে বড় প্রভাব এসেছে জনপ্রিয় সিরিজ 'ওয়েডনেসডে' থেকে। টিম বার্টন নির্মিত নেটফ্লিক্সের এই সিরিজে অভিনেত্রী জেনা ওর্টেগা অ্যাডামস চরিত্রে অভিনয় করেন।
তার চোখের চারপাশে ছায়া, ফ্যাকাসে মুখ আর অল্প রক্তিম ঠোঁট দর্শকের চোখে পড়ে। সিরিজের প্রথম মৌসুম থেকেই এই ‘লুক’ আলোচনায় আসে, আর দ্বিতীয় মৌসুমে তা আরও স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
সিরিজটির চুল ও মেইকআপ শিল্পী তারাহ ম্যাকডোনাল্ড সিএনএন ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেন, “জেনা’র স্বাভাবিক চোখের নিচের কালো দাগ আড়াল করতে চাইনি। বরং হালকা গাঢ় আইশ্যাডো ব্যবহার করে সেই দাগকেই বেশি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।”
আরেকজন শিল্পী নিরভানা জলালভান্দ যিনি দ্বিতীয় মৌসুমে কাজ করেছেন, বলেন— “ওয়েডনেসডে’ চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্যই হল, সে সাজগোজে সময় নষ্ট করে না। তার চোখেমুখে যে ক্লান্তি, সেটাই তার বাস্তবতার প্রতিফলন।”
এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যক্তিত্ব এমা চেম্বারলেইন, অভিনেত্রী লিলি রোজ-ডেপ এবং মডেল-সঙ্গীতশিল্পী গ্যাব্রিয়েট এই ধারা জনপ্রিয় করতে বড় ভূমিকা রেখেছেন।
তারা নানান অনুষ্ঠানে চোখের নিচের কালচে-ভাব ও অপরিপাটি সাজ নিয়েই হাজির হয়েছেন।
‘ক্লান্ত মুখ’ কেন ফ্যাশন?
দীর্ঘদিন ধরে ক্লান্ত মুখ বা চোখের নিচে দাগকে সৌন্দর্যের প্রতিবন্ধক হিসেবে ধরা হয়েছে। বাজারে আসা কনসিলার, ফাউন্ডেশন বা আন্ডার-আই ক্রিমগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল এসব চিহ্ন লুকানো।
তবে যুক্তরাজ্যের গ্লাস ম্যাগাজিনের সৌন্দর্য পরিচালক কিম ব্রাউন বলছেন, “এটা আসলে বাস্তবতাকে গ্রহণ করার বিষয়। টায়ার্ড গার্ল সাজে একটা শক্তি আছে। এটি অগোছালো হলেও সাহসী এবং ব্যতিক্রমী।”
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফিউচার ল্যাবরেটরি নামের প্রবণতা-গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপসম্পাদক ড্যান হেস্টিংস-নারায়ানিন বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন।
তার মতে, “গ্রাঞ্জ’ ধারা যেমন- সংগীত, সমাজবিরোধী চেতনা আর সংস্কৃতির সাথে যুক্ত ছিল; ‘টায়ার্ড গার্ল’ তেমন গভীর কোনো শেকড় গড়ে তোলেনি। এটি মূলত দ্রুত ছড়িয়ে পড়া একটি সামাজিক মাধ্যমভিত্তিক ক্ষণস্থায়ী প্রবণতা।”
অতীতের অনুপ্রেরণা
এই সাজ আসলে নতুন কিছু নয়। নব্বইয়ের দশকে মার্কিন গায়িকা কার্টনি লাভ ‘বেবি ডল’ পোশাক, অপরিপাটি চুল ও এলোমেলো আইলাইনারের মাধ্যমে ‘গ্রাঞ্জ’ ধারার সৌন্দর্য জনপ্রিয় করেছিলেন।
আরও আগে, চলচ্চিত্রে দেখা গেছে অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি অথবা তরুণী ন্যাটালি পোর্টম্যানকে ক্লান্ত ও বিষণ্ন ‘লুকে’।
তবে পার্থক্য হল, ‘টায়ার্ড গার্ল’ মূলত সামাজিক মাধ্যমভিত্তিক। যেমন- কোরিয়ান সৌন্দর্য জগতে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘এগিও-সাল’ মেইকআপ, যেখানে চোখের নিচের সামান্য ফোলা ভাবকে তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
তবে ‘টায়ার্ড গার্ল’ ধারা চায় সেই ক্লান্তি ও চোখের নিচের দাগকে ফ্যাশনেবলভাবে উপস্থাপন করতে।
‘ক্লিন গার্ল’ থেকে ‘টায়ার্ড গার্ল’
কয়েক বছর ধরে ‘ক্লিন গার্ল’ সাজ ছিল সৌন্দর্যপ্রেমীদের প্রিয়। উজ্জ্বল ত্বক, গালে হালকা লালচে ভাব, ঝকঝকে ঠোঁট— এই ছিল সেই ধারার বৈশিষ্ট্য।
সেলিব্রিটি বেলা হাদিদ, হেইলি বিবার বা কেন্ডাল জেনার এভাবেই প্রকাশ্যে আসতেন। তবে আজকের তরুণ সমাজের কাছে অতিরিক্ত পরিপাটি, অতিমাত্রায় কিউরেটেড সৌন্দর্য কিছুটা বিরক্তির জন্ম দিয়েছে।
নিরভানা জলালভান্দ সিএনএন ডটকমকে বলেন, “এখন মানুষ সাজের পাশাপাশি ছবিতেও এলোমেলো-ভাব চাইছে। নিখুঁত ফিল্টার বা ঝকঝকে ছবি নয়, বরং ব্লারি বা এলোমেলো ছবি বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে। এই সংস্কৃতিই ‘টায়ার্ড গার্ল’ মেইকআপকে জায়গা দিয়েছে।”
সহজে করা যায় এমন সাজ
‘টায়ার্ড গার্ল’ সাজ করার জন্য জটিল কৌশল বা দামি প্রসাধনী লাগে না। হালকা গাঢ় আইশ্যাডো চোখের নিচে লাগানো, ফাউন্ডেশনের চেয়ে কিছুটা হালকা বেস ব্যবহার করা আর ঠোঁটে অল্প রক্তিম রং দিলেই হয়ে যায়।
তারাহ ম্যাকডোনাল্ড বলেছেন, “এই সাজ করতে কারও খুব দক্ষ মেইকআপ আর্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই। এমনকি ব্রাশ ছাড়াই হাত দিয়ে এটি করা সম্ভব।”
সামাজিক প্রেক্ষাপট ও তরুণ প্রজন্মের বার্তা
ট্রেন্ড বিশেষজ্ঞ ড্যান হেস্টিংস-নারায়ানিন মনে করেন, "এ ধরনের ধারা আসলে তরুণদের মানসিক চাপের বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষাজীবন, অতিরিক্ত কাজের চাপ, ঋণের বোঝা, অনিশ্চিত চাকরির বাজার— সবকিছু মিলিয়ে তারা মানসিকভাবে ক্লান্ত।"
তিনি বলেন, “এই সাজ যেন এক ধরনের প্রতিবাদ। তারা বলছে ‘আমি ক্লান্ত, আমি অনিশ্চিত, তবে হাসি দিয়ে তা সামলাব।”
এই অর্থে ‘টায়ার্ড গার্ল’ শুধু সৌন্দর্যের সংজ্ঞা পাল্টাচ্ছে না, বরং এটি এক ধরনের সামাজিক বক্তব্যও দিচ্ছে।
ক্ষণস্থায়ী হলেও তাৎপর্যপূর্ণ
যদিও গবেষকরা মনে করছেন এই ধারা বেশিদিন টিকবে না, তবে এর আবির্ভাব গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ এটি দেখিয়েছে সৌন্দর্যের ধারণা সময়ের সাথে কীভাবে বদলে যায়। যেখানে একসময় সতেজ, নির্ভুল ও উজ্জ্বল মুখই ছিল মানদণ্ড; সেখানে এখন ক্লান্তি, এলোমেলো-ভাব আর অগোছালোতাকেও সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে মেনে নেওয়া হচ্ছে।
এমআই