মুহা: জিললুর রহমান, সাতক্ষীরা:
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বাকড়া গ্রামের বাসিন্দা মো: কবীর আহমেদ। গ্রামের পরিবেশে বড় হওয়ার কারণে উচ্চ শিক্ষিত হতে না পেরে ছেলে ওসমান গনিকে উচ্চ শিক্ষার জন্য সাতক্ষীরা শহরের একটি নামি স্কুলে ভর্তি করান। বিগত ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল শহরের স্কুলে পড়ুয়া ছেলে কে দেখতে শহরে আসে কবীর আহমেদ। ছেলের বায়না মিষ্টি খাওয়া জন্য মিষ্টি কিনতে যাওয়ায় তৎকালীন ডিবি পুলিশ তাকে শহরের পোষ্ট অফিস মোড়েস্থ হালিমা হোটেল থেকে তাকে গ্রেফতার করে। কবীর আহমেদ জামায়াতের সাথে সম্পৃকতা থাকার কারণে তাকে জীবনে মেরে ফেলার কথা জানান দেয় ডিবি পুলিশ।
পুলিশের সাবেক আই জি পি বেনজিন আহমেদ এর শশুরবাড়ী সাতক্ষীরাতে হওয়ার কারণে সাতক্ষীরাতে গড়ে তোলে মৎস্য ঘের ব্যবসা। তার ব্যাবসায়িক পার্টনার আশাশুনি উপজেলার সরাপপুর গ্রামের শামসুর রহমানের ছেলে মরহুম বসির আহমেদ । সাবেক আই জি পি বেনজিরের আর্শিবাদ পুষ্ট ভুমিদস্যু মহুম বসির আহমেদ কবীর আহমেদের প্রতিবেশী গ্রামের বসিন্দা হওয়ায় তার নিকটে সহদর ভাই যায়। কবীর আহমেদের ভাইয়ের কাছে ২লক্ষ টাকা দাবী করে ভাইকে জীবেনে মেরে না ফেলার জন্য। সন্ধ্যা রাতে দেড়লক্ষ টাকা রফাদফা হয় । রাত সাড়ে আটটার সময় কবীর আহমেদকে নিয়ে সাতক্ষীরা থেকে আশাশুনি থানার উদেশ্যে যাওয়ার সময় গভীর রাতে সাতক্ষীরা আশাশুনি সড়কের মহেশ্বরকাটি এলাকায় পুলিশ পিকআপ থেকে নামিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে পায়ে গুলি করে। উন্নত চিকিৎসার পরেও কবীর আহমেদের পা
ভাল না হওয়ায় পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবন যাপন করছে আজও। পঙ্গুত্ব পরেও তার নামে পুলিশ ৫ টি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। এ অসহয় জীবন
নিয়ে বিচারিক আদালতে হাজির হতে হয়। এমন অসংখ্যা ঘটনা ঘটেছে সাতক্ষীরাতে। বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের জন্য চরম আতঙ্কের জেলা ছিল ইসলামী আন্দোলনের মদীনা নামে খ্যাত সাতক্ষীরা জেলা। নির্যতন ও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ৩৭ নেতাকর্মীকে। এসময় ফ্যাসিস্টদের দোসর ও তাদের পেটুয়া বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন ও গুলিতে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছেন অর্ধশতাধিক জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী।
সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে ও ইসলামী আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে টার্গেট করা হয়েছিল জামায়াত-শিবিরকে। এই জেলায় তারা যাতে কখনো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেইজন্য ২০০৯ সালের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে জামায়াত-শিবিরকে দমন পিড়ন শুরু করে। যার চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষনার দিন। এদিন বিকালে শহরের অদূরে সার্কিট হাউজ মোড়ে
জামায়াতের শান্তিপূর্ন মিছিলে যৌথবাহিনী নির্বাচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ৭জন জামায়াত-শিবির নেতার্কীকে। এঘটনায় আহত হয় আরো অনেকে।
এঘটনার পর থেকে সাতক্ষীরা শহরসহ পুরো জেলা পরিনত হয় আতঙ্কের জেলায়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে শুরু হয় হয়রানি ও নির্যাতন। সরকার দলীয় লোকজন
পুলিশকে ব্যবহার করে জামায়াত-শিবির দমনে মেতে উঠে। প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হতো। একই সাথে চলে গ্রেফতারের নামে অর্থ বাণিজ্য। টাকা নেওয়ার পরও আটক জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের কারো পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়া হতো। আবার অনেককে শারীরিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে গুরুতর আহত করা হতো। এসময় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হওয়ার পাশাপাশি পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন অনেকে। পায়ে গুলিবিদ্ধ অনেকের পা কেটে ফেলতে হয়েছে।
পায়ে গুলিবিদ্ধ বাকিদের পক্ষে এখনও স্বাভাবিক চলাচল সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের নামে নির্যাতনের শিকার ৩৪ জন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী গুরুতর আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করে এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছে। আহত জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে, সাতক্ষীরা সদরের রইচপুর গ্রামের আমিরুল ইসলাম লাভলু (পা কাটাকাটা হয়েছে), দেবহাটার গরানবড়িয়া গ্রামের আব্দুল্লাহ (গুলিবিদ্ধ), একই উপজেলার মাসুম বিল্লাহ (গুলিবিদ্ধ), আকবার আলী (গুলিবিদ্ধ), সাদ্দাম হোসেন (গুলিবিদ্ধ), আব্দুস সবুর (গুলিবিদ্ধ), আবুল হোসেন (গুলিবিদ্ধ), বদরুল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), মেহেদী হাসান (গুলিবিদ্ধ), আব্দুর রশিদ মোল্লা (গুলিবিদ্ধ), ভ্যাদল (গুলিবিদ্ধ), আব্দুর রউফ (গুলিবিদ্ধ), রিয়াজুল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), আয়নুল হক (গুলিবিদ্ধ), কালিগঞ্জের চৌমুহনীর আশরাফুল ইসলাম বাবু (গুলিবিদ্ধ), রবিউল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), শুশিলগাতির ফারুক হোসেন (গুলিবিদ্ধ), দেবহাটার কুলিয়ার মাসুম বিল্লাহ (২২) (ধরে পাছায় গুলি করে পুলিশ), ভাড়ামিশলার আরিফুল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), দাদপুরের ইব্রাহিম (গুলিবিদ্ধ), একই গ্রামের মিয়ারাজ (গুলিবিদ্ধ), চালতেবাড়িয়ার রবিউল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), একই গ্রামের রিয়াজুল ইসলাম
(গুলিবিদ্ধ), আব্দুর রউফ (গুলিবিদ্ধ), সাতক্ষীরা সদর উপজেলার রইচপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যারয়ের ছাত্র সোহাগ (১২) (গুলিবিদ্ধ), রইচপুর গ্রামের মোহাম্মদ ইছাহাক (৩২) (গুলিবিদ্ধ), একই গ্রামের হোসেন ওরফে বাচা (২২) (গুলিবিদ্ধ)।
এছাড়া সাতক্ষীরা শহরের কামালনগর এলাকার একটি মেচে ঢুকে পুলিশ সাত শিবির কর্মীকে আটক করে তাদের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। এরা হলো আবু তালেব (গুলিবিদ্ধ), আব্দুল গফুর (গুলিবিদ্ধ), আব্দুস সবুর (গুলিবিদ্ধ), ইমরান হোসেন (গুলিবিদ্ধ), আজিজুল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), আক্তার হোসেন (গুলিবিদ্ধ), নুর মোহাম্মাদ (গুলিবিদ্ধ)।
আ’লীগের পেটুয়া বাহিনীর নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন কলারোয়া উপজেলার বৈদ্যপুর গ্রামের মিলন হোসেন, আরু ওবায়দা, শাহানার খাতুন, ক্ষেত্রপাড়া গ্রামের মুকুল হোসেন, হুমায়ূন কবির, মাদরা গ্রামের মফিজল ইসসাম, কলারোয়া গ্রামের শামসুল আলম বুলবুল, জয়নগর গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন, সদর উপজেলার রহচপুর গ্রামের আমিরুল ইমলাম লাভলু, কাশেমপৃর গ্রামের আব্দুল আহাদ, চপড়িয়া গ্রামের আব্দুর রহমান, আশাশুনির সরাপপুর গ্রামের কবির আহমেদ, নৈকাটি গ্রমের আল আমিন, দেবহাটার গরানবাড়িয়া গ্রামের রুহুল আমিন, মাঝসখিপুর গ্রামের রশিদ মোল্যা, সখিপুর গ্রামের মিলন হোসেন, পারুগ্রামের ফারুক হোসেন, একই গ্রামের আবু হোরায়রা, জগন্নাথপুর গ্রামের আহাদ উল্লাহ, শ্যামনগরের কাশিমাড়ি গ্রামের নজরুল ইসলাম, কালিগঞ্জের মাটিকুমড়া গ্রামের ফিরোজ হোসেন, দেবহাটা ভাড়াশিমলা গ্রামের রবিউল ইসলাম, সদর উপজেলার ইটাগাছা গ্রামের মফিজুল ইসলাম প্রমুখ।
এ ব্যাপারে জেলা জামায়াতে সেক্রেটারী আজিজুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ পুলিশকে ব্যবহার করে বিরোধী পক্ষকে দমনপীড়ন করছে। যেটি কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্র হতে পারে না। নতুন নতুন মামলা আবিষ্কার করে জনপ্রিয় নেতাকমীদের গ্রেফতার করছে। তিনি দাবি করেন এ পর্যন্ত তাদের ৩৭ জন নেতাকর্মীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জীবন দিতে হয়েছে। অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করে এখনো অনেকে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
আইনজীবি আবু তালেব বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত সাতক্ষীরাতে জামায়াতে ইসলামীর নেতা কর্মীদের নামে মিথ্যা ও রাজনৈতিক মামলা হয়েছে ৯৪৯ টি। ইতোমধ্যে সাত শতাধিক মামলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রঞ্জাপনের মাধ্যেমে নিস্পত্তি হয়েছে । বাকি মামলা নিস্পত্তির জন্য প্রক্রিয়াধিন ।আমরা সকল রাজনৈতিক, হয়রানি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহরের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ইতেমধ্যে অনেকের সাজা হয়েছে , উচ্চ আদালত হতে জামিনে মুক্ত হয়েছে।
এমআই