অ আ আবীর আকাশ:
প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্প এমন এক আতঙ্কের নাম, যা মুহূর্তের মধ্যে লাখো মানুষের জীবনযাত্রা থামিয়ে দিতে পারে। উন্নত প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা কিংবা আবহাওয়া স্যাটেলাইট— কোনোটাই এখনও ভূমিকম্পকে নিশ্চয়তার সঙ্গে পূর্বাভাস দিতে পারে না। ফলে এই দুর্যোগ যখন ঘটে, তখন মানুষের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা, ভয় ও অসহায়তা তৈরি হয়। শুক্রবার দুপুরে অনুভূত ভূমিকম্পও তেমনই এক ঘটনা, যা মুহূর্তের মধ্যে পুরো দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশে প্রায়ই হালকা-মাঝারি ভূমিকম্প অনুভূত হলেও সদ্য সংঘটিত এই কম্পনটি ছিল তুলনামূলক বেশি তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভবন কেঁপে ওঠা, মানুষজনের আতঙ্কে রাস্তার দিকে ছুটে যাওয়া,দেয়াল ধসে মৃত্যু, নবনির্মিত ভবনের ছাদ ধসে পড়ে বাপ ছেলের মৃত্যুসহ ক্ষয়-ক্ষতির নানা খবর পাওয়া যায়। সেই দিনের পরিস্থিতি এবং আমার দু’টি ভিন্ন সময়ের ভূমিকম্প-অভিজ্ঞতা মিলিয়ে স্মৃতিটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ভূমিকম্পের মুহূর্ত: দেশজুড়ে আতঙ্ক
শুক্রবারের সকালটি ছিল স্বাভাবিক। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলেও বিভিন্ন অফিসে অর্ধদিবস কাজ চলছিল, আবার অনেকে বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ঠিক এমন সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ মাটি কেঁপে ওঠার অনুভূতি হয়। প্রথমে হালকা ঢেউয়ের মতো অনুভূত হলেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেই কম্পন মাঝারি তীব্রতায় রূপ নেয়। বহু জেলার সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার, মিডিয়া হাউজ ও বাসাবাড়িতে কর্মরত মানুষ দ্রুত নিচে নেমে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় মুহূর্তেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে— কোথাও আলমারি দুলছে, কোথাও ঝাড়বাতি দোল খাচ্ছে, কোথাও দেয়াল-সিলিংয়ে ফাটল দেখা যাচ্ছে। আবার ভূমিকম্প নিয়ে কিছু অতিরঞ্জিত ও পুরনো ছবিও ছড়ানো হয়।
ভূমিকম্পের উৎস, মাত্রা ও গভীরতা সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার আগেই মানুষ আতঙ্কে জায়গা থেকে বেরিয়ে আসে। বাংলাদেশ ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলের মাঝামাঝি অবস্থিত হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা বরাবরই সতর্ক করে আসছেন যে যেকোনো সময় বড় ধরনের কম্পন ঘটতে পারে। ফলে সাম্প্রতিক এই ভূমিকম্প আবারও দেশের দুর্বল ভবন কাঠামো, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও মানুষের সচেতনতার ঘাটতিকে সামনে এনে দিয়েছে।
দেশব্যাপী ক্ষয়-ক্ষতি: সতর্কতার নতুন বার্তা
সৌভাগ্যবশত এই ভূমিকম্পে দেশে বড় ধরনের প্রাণহানি হয়নি। তবে নরসিংদীর নির্মানাধীন ভবন ও পুরান ঢাকায় দেয়াল ধসে পড়ার ঘটনাসহ বিভিন্ন জেলা শহরের বহু ভবনে সূক্ষ্ম ফাটল, দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, সাইনবোর্ড ও পুরনো অংশ ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ লাইন অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বড় বড় শপিংমল ও অফিস ভবন থেকে মানুষ দৌড়ে বের হয়ে আসায় সাময়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ভার্সিটি ও বিভিন্নস্থানে আতঙ্কে অনেকে লাফ দিয়ে আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
এদিকে মফস্বল ও পাহাড়ি অঞ্চলের কিছু কাঁচা-আধাপাকা ঘরে ছোটখাটো ক্ষতি হয়েছে। হঠাৎ ভীত হয়ে দৌড়ে নেমে আসার সময় কয়েকজন পড়ে গিয়ে আহত হন। রাজধানীতে বেশ কিছু উঁচু ভবনে বসবাসরত মানুষের মধ্যে সাময়িক মাথা ঘোরা বা আতঙ্কজনিত অস্বস্তিও দেখা গেছে।
এই ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বড় না হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ছিল একটি ‘ওয়েক-আপ কল’। কারণ দেশের বিপুল সংখ্যক ভবন এখনো ভূমিকম্প-সহনীয় মানে নির্মিত নয়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জরুরি প্রস্তুতি ব্যবস্থাও অনেকটাই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। ফলে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প কখনো এলে ক্ষয়-ক্ষতির মাত্রা ভয়াবহ হতে পারে।
আমার প্রথম অভিজ্ঞতা: প্রতিদিনের সংবাদ অফিস, তেজগাঁও
প্রায় আট-নয় বছর আগের কথা। তখন আমি তেজগাঁওয়ে প্রতিদিনের সংবাদে কর্মরত। সে সুবাদে পত্রিকাটির তেজগাঁও অফিসে আসা। সেদিন অন্যান্য সাধারণ দিনের মতো কাজ চলছিল— কেউ সংবাদ সম্পাদনায় ব্যস্ত, কেউ রিপোর্টের খুঁটিনাটি দেখছেন, কেউবা কম্পিউটারে টাইপ করছেন। হঠাৎ অনুভূত হলো, চেয়ারের নিচটা যেন দুলে উঠছে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো ভবন কেঁপে উঠল। প্রথমে মনে হয়েছিল হয়তো পাশ দিয়ে ভারী কোনো ট্রাক যাচ্ছে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কম্পনের তীব্রতা বেড়ে যায়। ঝুলন্ত কাগজ, সাইনবোর্ড, ফাইল— সব নড়তে শুরু করে।
অফিসে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। সবাই আতঙ্কে “দোয়া পড়তে পড়তে নিচে নামুন” বলে চিৎকার করতে থাকে। আমার সঙ্গে তখন ছিলেন মফস্বল সম্পাদক খন্দকার মোজাম্মেল হক এবং আরও অনেকে। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে আসার সময় সকলের মুখে একই দুশ্চিন্তা— ভবনটি যদি ভেঙে পড়ে? নিচে নেমে দেখি আশপাশের অন্য ভবন থেকেও মানুষ দৌড়ে বের হয়ে আসছে। রাস্তায় কয়েক মিনিটের জন্য বিশাল ভিড় তৈরি হয়। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন: “কী মাত্রার ভূমিকম্প ছিল?” যদিও পরে জানা গেল, ভূমিকম্পটি মাঝারি মাত্রার ছিল, তবে সেই মুহূর্তের ভয়ের অনুভূতি আজও স্পষ্ট।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা: পিআইবি’র পুরনো ভবনের ৫ তলা
শুক্রবারের ভূমিকম্পের কথা মনে হতেই আমার আরেকটি অভিজ্ঞতা যেন নতুন করে ফিরে আসে। পিআইবি (প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ)-র পুরনো ভবনের ৫ তলায় সাংবাদিকতা সংক্রান্ত একটি প্রশিক্ষণ চলছিলো। প্রশিক্ষক ছিলেন ড. জামিল হোসেন। ক্লাস চলছিল মনোযোগ দিয়ে। জরুরী কাজ থাকা আমিও পিআইবিতে ছিলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম— ভবনটা যেন আস্তে দুলছে। আগে যেমন হালকা কাঁপন হয়েছিল, এবার তা আরও পরিষ্কার।
প্রথম দফা কম্পন থামার পর অনেকে ভেবেছিল হয়তো ভুল অনুভূতি। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভবনটি দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারের মতো মাঝারি-জোরে কেঁপে ওঠে। ৫ তলায় অবস্থান করায় সবার ভয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। প্রশিক্ষক শান্ত থাকতে বললেও পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। সবাই দোয়া পড়তে পড়তে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করে। নিচে নেমে দেখি আশেপাশের ভবন থেকেও অনেকেই বেরিয়ে এসেছে। সামনে থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল— সবাই একই আতঙ্কের মধ্য দিয়ে গেছে।
শুক্রবারের ভূমিকম্প ও আমার স্মৃতি
শুক্রবারের ভূমিকম্পের সময়ও চারপাশে একই ধরনের অসহায়তা অনুভূত হয়। যদিও আমি তখন শারীরিকভাবে আগের অভিজ্ঞতার মতো বিপদে পড়িনি, কিন্তু ভয় ও উদ্বেগ যেন আগের দুই ঘটনার স্মৃতিকে আবার জাগিয়ে তোলে। মানুষ একটা অদৃশ্য শক্তির সামনে কতটা ক্ষুদ্র— ভূমিকম্পের প্রতিটি ঘটনার পর এটাই সবচেয়ে বেশি মনে হয়।
ভূমিকম্পের সময় মানুষের দৌড়ে নেমে যাওয়া, নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া, দোয়া পড়া— এগুলো সবই মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। প্রকৃতির প্রতি এই ভীতিটাই যেন আবারও মনে করিয়ে দেয় যে আধুনিকতা আমাদের দুর্ঘটনামুক্ত করেনি।
দুর্যোগ প্রস্তুতি: এখনই প্রয়োজন কঠোর বাস্তবায়ন
ভূমিকম্প সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ খুবই স্পষ্ট
* পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি
* প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস ও আবাসিক ভবনে নিয়মিত ফায়ার ড্রিল
* পরিবারে ভূমিকম্পের সময় কী করবে— সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ
* ভবন নির্মাণে ভূমিকম্প-সহনীয় মান কঠোরভাবে প্রয়োগ
* জরুরি উদ্ধার, চিকিৎসা ও আশ্রয় ব্যবস্থার উন্নয়ন
ফলস্বরূপ, মাঝারি মাত্রার কম্পনেও ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কমবে, মানুষের আতঙ্কও কমবে।
শুক্রবারের ভূমিকম্প আবারও আমাদের সামনে তুলে ধরেছে— কত অল্প সময়ে কত বড় ঘটনা ঘটে যেতে পারে। প্রকৃতি কখনোই সতর্ক করে আসে না, তাই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হয় আগেই। আমার দুই সময়ের ভূমিকম্প-অভিজ্ঞতা এবং সাম্প্রতিক ঘটনার ভয়-দ্বন্দ্ব মিলিয়ে আবারও মনে হলো, মানুষের পরিকল্পনা, শক্তি কিংবা প্রযুক্তি— কোনো কিছুই প্রকৃতির সামনে শতভাগ নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তবে সঠিক সচেতনতা, প্রস্তুতি এবং নিরাপদ ভবন কাঠামো থাকলে ক্ষয়-ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব।
ভূমিকম্প আমাদের শেখায়— আমরা সবাই একইভাবে দুর্বল, একইভাবে মানবিক। আর সেই মানবিকতার জায়গা থেকেই নিরাপত্তা ও প্রস্তুতির ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়া জরুরি।
লেখক: অ আ আবীর আকাশ,
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।