নিজস্ব প্রতিবেদক:
দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) কমিশনার পদ তিন থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে পাঁচজন। তাদের মধ্যে একজন থাকবেন নারী কমিশনার। পাঁচ বছরের পরিবর্তে কমিশনারদের মেয়াদ করা হচ্ছে চার বছর। এ ছাড়া দুদকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে গঠন করা হচ্ছে একটি পর্যালোচনা কমিটি (ওভারসাইট বডি)। যে কমিটির কাছে কমিশনকে প্রতি ১২ মাস পরপর সার্বিক কার্যক্রমের বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। এ-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রায় চূড়ান্ত। শিগগির তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হওয়ার কথা রয়েছে। দুদক ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র কালবেলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকর, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন’ গঠন করে। আট সদস্যের এ কমিশনে কমিশন প্রধান করা হয়েছিল টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানকে। ওই কমিশনের ৪৭টি সুপারিশের মধ্যে অন্যতম ছিল দুদকের কমিশনার সংখ্যা পাঁচজনে উন্নীত করা। তাদের মধ্যে একজন থাকবেন নারী। বর্তমানে কমিশনে তিনজন কমিশনার রয়েছেন। তাদের একজন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অন্য দুজনের মধ্যে একজন কমিশনার (তদন্ত) এবং আরেকজন কমিশনার (অনুসন্ধান) হিসেবে সার্বিক তত্ত্বাবধান ও তদারকির দায়িত্ব পালন করেন। দুদকের নেতৃত্ব বহুমাত্রিক এবং বহু পেশার সমন্বয়ে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করতে কমিশনার সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী আইন সংশোধন করে কমিশনারের সংখ্যা পাঁচজন করা হচ্ছে। তাদের মেয়াদ করা হচ্ছে চার বছর।
এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘পাঁচজন কমিশনার দ্বারা কমিশন গঠনের বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে। শিগগির কমিশনার নিয়োগ-সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।’
এদিকে কমিশনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে একটি ওভারসাইট বডি বা পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হবে। বর্তমানে কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য পাঁচ সদস্যের (প্রস্তাবিত ৭ সদস্য) যে বাছাই কমিটি রয়েছে, সেটিই ওভারসাইট বডি হিসেবে কাজ করবে। এ কমিটির সদস্যরা নিয়মিত বিরতিতে বা প্রতি ১২ মাস পরপর দুদকের কার্যক্রম পর্যালোচনা করবেন। দুদক সংস্কার কমিশন দুদক আইন-২০০৪-এর ৭ ধারার অধীনে গঠিত বাছাই কমিটির নাম পরিবর্তন করে ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ নামে অভিহিত করেছে। বর্তমানে এ কমিটিতে যারা রয়েছেন তারা হলেন—প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক, প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবদের মধ্যে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব। কিন্তু প্রস্তাবিত বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটিতে সদস্য সংখ্যা করা হয়েছে সাতজন। তারা হলেন—প্রধান বিচারপতি ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি (তিনি পদাধিকার বলে কমিটির চেয়ারম্যান হবেন)। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি, বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) চেয়ারম্যান, জাতীয় সংসদের সংসদ নেতা মনোনীত একজন প্রতিনিধি, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা মনোনীত একজন প্রতিনিধি ও প্রধান বিচারপতি মনোনীত দুর্নীতিবিরোধী ও সুশাসনের জন্য কাজে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বাংলাদেশের একজন নাগরিক। বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি দুদকের কমিশনার নিয়োগের জন্য নাম বাছাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। পাশাপাশি তারা নিয়মিতভাবে দুদকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে।
দুদকের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা জানান, কমিশনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি গঠন প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। শিগগির তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে। প্রশ্ন উঠেছে—এ কমিটি স্বাধীন কমিশনের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করবে কি না?
জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গত সোমবার কালবেলাকে বলেন, ‘বাছাই কমিটির সদস্য সংখ্যা পাঁচ থেকে সাতে উন্নীত করাটা ঠিক আছে। তারা বিজ্ঞ ও সজ্জন ব্যক্তিকে কমিশনার বাছাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম সুপারিশ করবে। কিন্তু তারা কমিশনের সামগ্রিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করতে গেলে কমিশনকে তাদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ জবাবদিহি কমিশনের স্বাধীনতাকে খর্ব করবে। কমিশনের আইনে এ ধরনের কোনো সুযোগ রাখা ঠিক হবে না। এ ধরনের সুযোগ থাকলে কমিশনের স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হবে। কমিশন শুধু আইনের কাছে জবাবদিহি করবে।’
দুদক সংস্কার কমিশনের এক সদস্য কালবেলাকে বলেন, ‘সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বাছাই কমিটির নাম পরিবর্তনের সুপারিশ রয়েছে। তারা কমিশনারদের নাম বাছাইয়ের পাশাপাশি কমিশনের কার্যক্রম পর্যালোচনা করবে। এতে কমিশনের কার্যক্রম আরও স্বচ্ছ ও গতিশীল হবে। কমিশনার পাঁচজন হলে কমিশনের কার্যক্রম আরও স্বাধীন ও স্বচ্ছ হবে।’
দুদকের কমিশনার তিনজন থেকে পাঁচজনে উন্নীত করার অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ বলেন, ‘সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে কমিশনার তিন থেকে পাঁচজন করার বিষয়ে কার্যক্রম চলমান আছে। তবে সেটা বর্তমান কমিশনার যারা আছেন (চেয়ারম্যানসহ) তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। নতুন যারা কমিশনার হবে তাদের ক্ষেত্রে চার বছর মেয়াদসহ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুদকের বিভিন্ন সংস্কার বিষয়ে আমাদের সামগ্রিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি হতে কিছুটা সময় লাগবে।’
পদবিন্যাস জটিলতা নিরসন দাবি: দুর্নীতি দমন কমিশনে কর্মকর্তাদের জন্য বর্তমানে সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, পরিচালক ও মহাপরিচালক—এ চারটি পদবিন্যাস রয়েছে। কিন্তু প্রায় কাছাকাছি তদন্ত কার্যক্রমে অংশ নেওয়া পুলিশে ক্যাডার ধাপ আটটি। সহকারী পুলিশ সুপার, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত ডিআইজি, ডিআইজি, অতিরিক্ত আইজি ও আইজি। দুদক কর্মকর্তারা সহকারী পরিচালকের পর সিনিয়র সহকারী পরিচালক, অতিরিক্ত উপপরিচালক, উপপরিচালক, যুগ্ম পরিচালক, অতিরিক্ত পরিচালক, পরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও মহাপরিচালক—এভাবে পদবিন্যাস দাবি করেছেন। বিষয়টি নিয়ে দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদেনের সুপারিশেও কিছু বলা হয়নি। তবে সেখানে মোট কর্মকর্তার মাত্র ১০ শতাংশ প্রেষণে আনার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে দুদকে আটজন মহাপরিচালকের ছয়জনই প্রেষণে অন্য দপ্তর থেকে আসা। দুদক কর্মকর্তারা প্রেষণে আসা কর্মকর্তার সংখ্যা কমানো ও পদবিন্যাসের দাবি জানিয়েছেন।
এ ছাড়া দুদকের অর্গানোগ্রামে ২০৯৪টি পদ রয়েছে। বর্তমানে জনবল আছে প্রায় ১ হাজার ২৫০ জন। সাড়ে ৮শর মতো পদ খালি রয়েছে। এ বিষয়টিরও সুরাহার কথা বলেছেন কর্মকর্তারা। যদিও এ বিষয়ে দুদকের কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
একে