বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫

আগুনের ঝুঁকিমুক্ত ব্যাটারি বানালেন বিজ্ঞানীরা

বুধবার, ডিসেম্বর ২৪, ২০২৫
আগুনের ঝুঁকিমুক্ত ব্যাটারি বানালেন বিজ্ঞানীরা

সময় জার্নাল ডেস্ক:

স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি—আধুনিক জীবনের প্রায় সবকিছুতেই এখন লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবহার হয়। সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও চার্জ দিলে এগুলো সাধারণত নিরাপদ। তবে আঘাত, অতিরিক্ত তাপমাত্রা বা ত্রুটির কারণে এই ব্যাটারি থেকে আগুন লাগার হাজারো নজির রয়েছে, যা অনেক সময় প্রাণঘাতী পরিণাম ডেকে আনে।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে দাহ্য তরল ইলেকট্রোলাইট থাকে। এটি মূলত জৈব দ্রাবকে দ্রবীভূত লিথিয়াম লবণের তরল দ্রবণ, যা বিদ্যুৎ প্রবাহ সচল রাখে। কিন্তু ছিদ্র হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত চার্জ হওয়া কিংবা উৎপাদনগত ত্রুটির কারণে ব্যাটারি দ্রুত গরম হয়ে 'থার্মাল রানঅওয়ে' বা বিপজ্জনক চেইন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে আগুন ধরে যেতে পারে।

উড়োজাহাজে ব্যাটারিচালিত ডিভাইসের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে বাণিজ্যিক বিমান চলাচল খাত এই ঝুঁকির মুখে সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) চেক করা ব্যাগেজে অতিরিক্ত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি বহন নিষিদ্ধ করেছে। সংস্থাটি ২০২৪ সালে যাত্রীবাহী ও কার্গো বিমানে ব্যাটারি থেকে ধোঁয়া, আগুন বা অতিরিক্ত তাপমাত্রার ৮৯টি ঘটনা এবং ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে এমন ৩৮টি ঘটনা রেকর্ড করেছে।

এসব ঘটনা অনেক সময় বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। যেমন—চলতি বছরের জানুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে একটি পাওয়ার ব্যাংক থেকে এয়ারবাস এ৩২১ বিমানে আগুন লেগে সেটি ভস্মীভূত হয়ে যায়। তদন্তকারীদের ধারণা, ওভারহেড কম্পার্টমেন্টে রাখা একটি পাওয়ার ব্যাংক থেকে ওই আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল।

ঝুঁকি কেবল বিমানেই সীমাবদ্ধ নয়। বাসাবাড়িতে ই-বাইক বা ই-স্কুটারের ব্যাটারি এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। ২০২৪ সালে বিমা প্রদানকারী সংস্থা আভিভা যুক্তরাজ্যের পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে, অর্ধেকেরও বেশি প্রতিষ্ঠান লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি সংক্রান্ত স্পার্কিং, আগুন বা বিস্ফোরণের মতো ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে গবেষকরা নিরাপদ ব্যাটারি তৈরির চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ তরল ইলেকট্রোলাইটের পরিবর্তে কঠিন বা জেল ব্যবহারের কথা ভাবছেন। তবে এসব সমাধানে বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, যা বাস্তবায়ন করা কঠিন।

তবে এবার হংকংয়ের চাইনিজ ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির নকশায় এমন এক পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যা দ্রুত বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থায় যুক্ত করা সম্ভব। কারণ, এতে কেবল বিদ্যমান ইলেকট্রোলাইট দ্রবণের রাসায়নিক উপাদান অদলবদল করতে হবে।

গবেষণাটির প্রধান ইউ সান (বর্তমানে ভার্জিনিয়া টেকের পোস্টডক্টরাল ফেলো) বলেন, 'ব্যাটারি নিয়ে মানুষের জন্য সবচেয়ে কঠিন যে বিষয়টি উপলব্ধি করা দরকার তা হলো, যখন আপনি পারফরম্যান্স বা কার্যক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন, তখন অনেক সময় নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করতে হয়।'

তিনি ব্যাখ্যা করেন, পারফরম্যান্স বাড়াতে সাধারণ তাপমাত্রায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়, আর নিরাপত্তা বাড়াতে উচ্চ তাপমাত্রার বিক্রিয়ার ওপর ফোকাস করতে হয়।

তিনি বলেন, 'তাই আমরা তাপমাত্রা-সংবেদনশীল একটি উপাদান তৈরির মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধানের কথা ভেবেছি, যা সাধারণ তাপমাত্রায় ভালো পারফরম্যান্স দেবে এবং উচ্চ তাপমাত্রায় ভালো স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।'

ব্যাটারিতে আগুন সাধারণত তখন লাগে, যখন ইলেকট্রোলাইটের কোনো অংশ চাপের মুখে ভেঙে যায় এবং চেইন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে তাপ নির্গত করে। 

যেভাবে কাজ করে

ইউ সান ও তার সহকর্মীদের নকশায় একটি নতুন ইলেকট্রোলাইট ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে দুটি ভিন্ন দ্রাবক রয়েছে।

সাধারণ তাপমাত্রায় প্রথম দ্রাবকটি ব্যাটারির রাসায়নিক কাঠামো ঠিক রাখে এবং কার্যক্ষমতা বজায় রাখে। কিন্তু ব্যাটারি গরম হতে শুরু করলে দ্বিতীয় দ্রাবকটি সক্রিয় হয়। এটি কাঠামোটিকে শিথিল করে এবং যেসব বিক্রিয়ার কারণে 'থার্মাল রানঅওয়ে' হতে পারে, সেগুলোর গতি ধীর করে আগুন প্রতিরোধ করে।

ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রচলিত ব্যাটারিতে যখন পেরেক দিয়ে ফুটো করা হয়, তখন তাপমাত্রা যেখানে ৫৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৯৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পৌঁছেছিল, সেখানে নতুন নকশার ব্যাটারিতে তাপমাত্রা বেড়েছে মাত্র ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৬.৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। গবেষকরা বলছেন, এতে ব্যাটারির স্থায়িত্ব বা কার্যক্ষমতায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না। ১,০০০ বার চার্জ করার পরও এটি ৮০ শতাংশের বেশি সক্ষমতা ধরে রাখতে পারে।

হংকংয়ের চাইনিজ ইউনিভার্সিটির মেকানিক্যাল অ্যান্ড অটোমেশন ইঞ্জলিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং এই গবেষণার অন্যতম লেখক ই-চুন লু বলেন, 'যেহেতু আমাদের উদ্ভাবনটি ইলেকট্রোলাইট কেন্দ্রিক, তাই এটি বাণিজ্যিকভাবে সহজলভ্য সিস্টেমে সহজেই প্রয়োগ করা সম্ভব—মূলত শুধু নতুন ইলেকট্রোলাইট দিয়ে পুরনোটি বদলে দিলেই হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে কঠিন অংশ হলো ইলেকট্রোড বা কঠিন অংশ। কিন্তু আমরা যে ইলেকট্রোলাইট পরিবর্তন করছি তা তরল, তাই কোনো নতুন যন্ত্রপাতি বা প্রক্রিয়া ছাড়াই এটি সরাসরি সেলে ইনজেক্ট করা যায়।'

নতুন রাসায়নিক উপাদানের কারণে উৎপাদন খরচ সামান্য বাড়তে পারে। তবে লু জানান, বড় পরিসরে উৎপাদন করলে এর দাম বর্তমান ব্যাটারির 'খুবই কাছাকাছি' থাকবে। গবেষকরা এটি বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনার জন্য ব্যাটারি প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। এটি বাজারে আসতে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গবেষণায় ট্যাবলেট চালানোর মতো বড় ব্যাটারি তৈরি করা হয়েছে। তবে বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় আকারের ব্যাটারি তৈরির ক্ষেত্রে নকশাটি আরও যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক লু।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিনিউএবল এনার্জি ল্যাবরেটরির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ডোনাল্ড ফিনেগান সিএনএনকে বলেন, নতুন এই নকশা একটি উত্তেজনাপূর্ণ অগ্রগতি। এটি এমন একটি নিরাপদ ব্যাটারি তৈরি করে যা গরম অবস্থা এবং শর্ট সার্কিট সহ্য করতে পারে।

টেক্সাস এঅ্যান্ডএম ইউনিভার্সিটির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক জোর্হে সেমিনারিও বলেন, 'গবেষণাটি অত্যন্ত উদ্ভাবনী ও প্রভাবশালী। এটি লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি জটিল সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান দিচ্ছে।'

এমআই


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল